odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 5th November 2025, ৫th November ২০২৫

প্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম : ওষুধবিজ্ঞানীদের বিনম্র শ্রদ্ধা

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ৩০ June ২০২০ ০৪:৫৮

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ৩০ June ২০২০ ০৪:৫৮

  •  

 

প্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম : ওষুধবিজ্ঞানীদের বিনম্র শ্রদ্ধা

 

দেশের ওষুধবিজ্ঞানী বা ফার্মাসিস্টদের কাছে মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে ওষুধ সেক্টরে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা এখন পর্যন্ত অতুলনীয়। বিশেষ করে ওষুধবিজ্ঞানীদের জন্য তিনি যে কাজগুলো করে গেছেন সেগুলো যদি ধরে রেখে অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে তা দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরে এক বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। তাঁর প্রয়াণে তাই ওষুধবিজ্ঞানীরা একান্ত শোকগ্রস্ত। 

ওষুধবিজ্ঞান যেহেতু চিকিৎসকদের মতোই সরকার স্বীকৃত একটি পেশা, তাই বাংলাদেশের ফার্মাসিস্টদেরকে গ্র্যাজুয়েশনের পর আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত করার জন্য ‘বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল’ সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু কতিপয় সুযোগসন্ধানীদের হীন স্বার্থে ২০০৩ সাল থেকে এই নিবন্ধন প্রদান হঠাত্ বেআইনিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ওষুধবিজ্ঞানে সদ্য গ্র্যাজুয়েটরা এর ফলে নিবন্ধিত হতে পারছিলেন না। ২০০৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে সঙ্গে নিয়ে সেই সময়কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই অচলাবস্থার অবসান করেন। এর ফলে দেশের প্রায় সাত হাজার ফার্মাসিস্ট এই পেশায় নিবন্ধিত হয়ে ওষুধবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। নবীন পেশাজীবীদের পক্ষে এই অবদান ভুলে যাওয়ার নয়। 

তৃতীয় জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নের কাজ স্বনামধন্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে শুরু হলেও এটি পূর্ণাঙ্গ আকারে ঘোষিত হয় ২০১৬ সালে। এটি ছিল ১৯৮২ সালের যুগান্তকারী প্রথম জাতীয় ওষুধনীতির পর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ওষুধনীতি। কারণ এটি ছিল এই উপমহাদেশ ও সমগ্র পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র জাতীয় ওষুধনীতি, যেখানে আধুনিক বা এলোপ্যাথি চিকিত্সাবিজ্ঞানের পাশাপাশি আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি, হার্বাল, হোমিওপ্যাথি ও বায়োকেমিক শাস্ত্রগুলোকে নিয়ে প্রণীত ও এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা একটি জাতীয় ওষুধনীতি। 

এই ওষুধনীতিতে দেশের জন্য প্রথমবার ১) এলোপ্যাথির পাশাপাশি আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি, হোমিওপ্যাথি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাও প্রণয়ন করা হয়; ২) প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা যাবে এমন ওষুধের তালিকা বা ওটিসি ড্রাগ লিস্টও তৈরি করা হয়; ৩) নিম্নমান, নকল ও ভেজাল ওষুধ বন্ধ করতে এলোপ্যাথ, আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি, হার্বাল, হোমিওপ্যাথি ও বায়োকেমিক ওষুধ উত্পাদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাকটিস বা জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ বাধ্যতামূলক করা হয়; ৪) যেকোনো শাস্ত্রের কোনো ওষুধ ব্যবহার করে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হলে উত্পাদনকারী কম্পানি ও বিক্রেতা ফার্মেসি উভয়কেই ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্যতার নিয়ম করা হয়; এবং ৫) জনগণকে নকল, ভেজাল, নিম্নমান ও অনিবন্ধিত চোরাচালানকৃত-মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের হাত থেকে রক্ষা ও নির্ধারিত খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে, সেই সঙ্গে ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশের সব ছোট-বড় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ‘হসপিটাল ফার্মেসি’ এবং সাধারণ্যে ওষুধের খুচরা বিক্রি পর্যায়ে ‘মডেল ফার্মেসি’ চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

ক্রমিক ১ থেকে ৫ পর্যন্ত সবগুলো রোগীবান্ধব সিদ্ধান্তই এই দেশের জন্য প্রথমবার নেওয়া এবং আগের কোনো সরকারই সমস্যার এতটা গভীরে যায়নি। নাসিম সাহেব গিয়েছিলেন এবং তিনি আন্তরিক বিশ্বাস থেকেই ওষুধনীতি প্রণয়ন উপকমিটিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর এসব কাজ, বিশেষ করে ‘হসপিটাল ফার্মেসি’ ও ‘মডেল ফার্মেসি’ চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের সঙ্গে সঙ্গে ফার্মাসিস্ট বা ওষুধবিজ্ঞানীদের পেশাগত অধিকার স্বীকার করে নেওয়ার বিষয়টির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও তাত্পর্য রয়েছে। বারান্তরে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

 

অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে এ দেশের ওষুধ খাতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। ২০১০ সালে ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে এ দেশে দ্বিতীয়বার শিশুমৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যম ও আইনপ্রণেতা উভয় মহলই প্রতিবাদমুখর হন। তার ফলে মহান জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেশের সবগুলো এলোপ্যাথিক ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করে তাদের মানসম্পন্ন ওষুধ উত্পাদনের সক্ষমতা বিষয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রদানের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ পরিদর্শন কমিটি গঠন করেন। কয়েক বছর ধরে দেশের সবগুলো কারখানা উপর্যুপরি পরিদর্শনের পর এই কমিটি ২০১৬ সালে তাদের চূড়ান্ত রিপোর্টে ২০টি ওষুধ কম্পানির লাইসেন্স বাতিলসহ দেশের মোট ৬২টি এলোপ্যাথিক ওষুধ কারখানার বিরুদ্ধে জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে। 
এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। কারণ বিগত কোনো সরকারই এসব কালো ওষুধ কম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পায়নি। এতগুলো কম্পানির বিরুদ্ধে তো নয়ই। তাদের কালো টাকার দাপট এতই বেশি যে সুস্থ মানুষকেও কালো বানাতে তাদের খুব সময় লাগে না। কিন্তু নাসিম সাহেব সেই সাহস দেখিয়েছিলেন। সেদিন মাননীয় উচ্চ ও সর্বোচ্চ আদালতও জনগণের পক্ষে যে ন্যায়সংগত সহমর্মিতা দেখিয়েছিলেন তার কারণে বেশ কিছু আমলাতান্ত্রিক বাধা অতিক্রম করে এসব সুপারিশ সম্পূর্ণতা না হলেও বেশির ভাগই তিনি বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। জনগণকে মানসম্পন্ন ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা অগ্রগতির জন্য দেশের ওষুধবিজ্ঞানীরা তাই তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছে ঋণী।
তাঁর মন্ত্রিত্ব মেয়াদের শেষ দিকে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন। জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬ অনুযায়ী রোগীদের জন্য ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিফলন হিসেবে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ‘হসপিটাল ফার্মেসি’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের পদ সৃষ্টি ও তাদের জন্য একটি ‘ডিরেক্টরেট অব ফার্মাসিউটিক্যাল সার্ভিস’ বা ‘ওষুধ সেবা পরিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠার নীতিগত অনুমোদন দিয়ে গেছেন। যথাযথ সরকারি নিয়মনীতি মেনেই তা করা হয়েছে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি অত্যন্ত গরিব দেশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশেই এই ‘হসপিটাল ফার্মেসি’ ব্যবস্থা রয়েছে। বিষয়টি এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। আমরা আশা করি, সরকার যেহেতু ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার স্বার্থে এ বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক, তাই দ্রুতই এই অপেক্ষার পালা শেষ হবে। ফলে দেশের জনস্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতের উন্নয়নে এটি হবে এই সরকারের জন্য আরেকটি মাইলফলক সাফল্য। 

দীর্ঘ সময় মন্ত্রী থাকাকালে তাঁর কিছু কাজের জন্য তিনি সমালোচিত হতেই পারেন। গুরুতর কোনো অভিযোগ থাকলে সরকার হয়তো সেগুলো খতিয়ে দেখবে। কিন্তু আমরা ফার্মাসিস্টরা তাঁকে নিয়ে আলোচনার সময় যতটুকু আমরা জানি তা নিয়েই আলোচনা করব। ওষুধবিজ্ঞানীদের এতকাল ধরে সরকারগুলো শুধু অবমূল্যায়নই করে এসেছে। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদেরকে ওষুধবিজ্ঞানী মনে না করে যেভাবে ওষুধের মুদি দোকানের কম্পাউন্ডার বা টেকনিশিয়ান মনে করা হয়েছে তাতে আমাদের অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতের উন্নয়নে ওষুধবিজ্ঞানীদের ভূমিকাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর মতানুযায়ী নাসিম সাহেব ও আরো কেউ কেউ যে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেছেন এবং করেন তার জন্য আমরা আশাবাদী হতে চাই। 

ফার্মাসিস্টদের প্রশংসায় তিনি সব সময়েই ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। আমরা ফার্মাসিস্টরা যে দেশের বার্ষিক চাহিদার ৯৮ শতাংশ দেশেই উৎপাদন করি, দেশে যে বছরে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকার ওষুধ উত্পাদিত হয়, আমরা যে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ১৪১টি দেশে (বর্তমানে ১৫২) ওষুধ রপ্তানি করি, এগুলো তিনি প্রায়ই তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করতেন। বাংলাদেশে মডেল ফার্মেসি প্রতিষ্ঠায় তাঁর আন্তরিকতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি জানতেন এটি হচ্ছে বিরুদ্ধ স্রোতে যাত্রা, যা রাজনীতিকরা সচরাচর করতে চান না। কিন্তু মডেল ফার্মেসি ইস্যুতে তিনি সেই কাজটি করেছেন। হাঁটতে তাঁর কষ্ট হতো। কিন্তু তবু তিনি বলতেন, ‘গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের দায়িত্ব দিয়ে কেউ মডেল ফার্মেসি খুললে বাংলাদেশের যেখানেই হোক. যত দূরেই হোক— আমি উদ্বোধন করতে যেতে রাজি আছি।’ আরো বলতেন, ‘আমাদের দেশের ওষুধের দোকানগুলো এভাবে চলতে পারে না। এখন যেভাবে আছে এগুলোর রিনিউয়াল আর হবে না। রিনিউ করতে হলে মডেল ফার্মেসির নিয়মে করতে হবে।’ ‘ওষুধের নতুন দোকানের পারমিশন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা যদি কেউ মডেল ফার্মেসির মালিক হিসেবে খুলতে চায়, আসেন। যদি ড্রাগ (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) থেকে পারমিশন না দেয়, আমার কাছে আসবেন। আমি লাইসেন্স দেব।’

বাংলাদেশের ওষুধবিজ্ঞানীরা সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তাঁর জোরালো অবদানের জন্য দীর্ঘদিন মনে রাখবে। তাঁকে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। রাব্বুল আলামিনের কাছে আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার; সাবেক চেয়ারম্যান, 
ফার্মেসি বিভাগ ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ; সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: