odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 5th November 2025, ৫th November ২০২৫

মাস্কের ধরন, ব্যবহার ও কার্যকারিতা

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ৯ December ২০২০ ১৭:৫৯

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ৯ December ২০২০ ১৭:৫৯

 

 
মাস্কের ধরন, ব্যবহার ও কার্যকারিতা
 

আসন্ন শীতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের মতো বাংলাদেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আশঙ্কা করছেন। সরকারও এই আশঙ্কাকে আমলে নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তুতি গ্রহণের কথা জানিয়েছে। ইতিমধ্যে বেক্সিমকো ফার্মা ও সিরাম ইন্ডিয়ার মাধ্যমে সরকার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগের ৩ কোটি টিকা পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আরো বিভিন্ন দেশের টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। করোনা মহামারি প্রতিরোধে গঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কোয়ালিশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে। নিজেদের তৈরি তহবিল ছাড়াও টিকা দ্রুত ও নগদ মূল্যে কেনার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের কাছে কিছু তহবিল চেয়েছে। অন্যতম আরেকটি কাজ হলো সরকারি দপ্তরগুলোতে যে কোনো সেবা নিতে আসা মানুষদের মধ্যে যাদের মুখে মাস্ক থাকবে না তাদের সেবা দেওয়া যাবে না, দেশব্যাপী এই নির্দেশ প্রচার করা এবং তা কার্যকরের সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।

 

উল্লিখিত সবগুলো উদ্যোগই ভালো এবং শেষোক্ত এই উদ্যোগটি অত্যন্ত জোরালোভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সামাজিকভাবে করোনার বিস্তার প্রতিরোধে টিকা নেওয়ার পাশাপাশি জনগণকে মাস্ক পরা, ছয় ফুটের দূরত্ব বজায় রাখা, সাবান ও পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া, দিনে কয়েকবার সাবান ও পানি দিয়ে মুখ ধোয়া, অফিসের বা ঘরের বাইরে যেখানে সাবান-পানির ব্যবস্থা নেই সেখানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, হাত না ধুয়ে মুখে-নাকে বা চোখে হাত না লাগানো বা না চুলকানো, করোনা ভাইরাসটি বায়ুবাহিত বলে বাইরে গেলে মাস্কের সঙ্গে চোখে বড় চশমা পরা, ভিড়ে ও জনসমাগমে না যাওয়া, ধাক্কাধাক্কি করে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে না ওঠা, রেস্টুরেন্টের খাবার সেখানে বসে না খেয়ে বাড়িতে এনে খাওয়া, কাগজ বা টাকা গোনা ও বইয়ের পাতা উলটানোর সময় জিহ্বা থেকে আঙুল ভিজিয়ে না নেওয়া, বাইরে থেকে ঘরে ফিরে বাইরের কাপড় বদলে ফেলা ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে।

তবে মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা এবং সঠিক নিয়মে কীভাবে মাস্ক পরতে হবে—এ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সচেতনতার ভীষণ অভাব রয়েছে। ব্যাপক আকারে এই সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এর প্রয়োজন ও সঠিক নিয়ম সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে ঘন ঘন প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার।

 

করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর সময় যখন একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার অবিশ্বাস্য উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছিল তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার থেকে জনমানুষের জন্য এই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিনা মূল্যে বিতরণ এবং ‘ইত্তেফাক’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় এর ফর্মুলা এবং কীভাবে এটি তৈরি করতে হবে, তা জানাই। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এর দাম কমিয়ে আনে। এবারও জনস্বার্থে মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা প্রচারের পাশাপাশি কীভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে না গিয়ে কম খরচে নিজেরাই নিজেদের মাস্ক তৈরি করা যায় জনস্বার্থে আমাদের কেন্দ্র থেকে তা জানাচ্ছি। কারণ মাস্ক পরার জন্য অনেক দাম দিয়ে তা কেনার কোনো প্রয়োজন নেই।

আপনার তৈরি মাস্কটি কার্যকর হবে কি না, সে প্রশ্ন আসতেই পারে। একটা সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে তা যাচাই করা যেতে পারে। একটি মোমবাতি জ্বালান। মাস্ক মুখে লাগিয়ে জ্বলন্ত মোমবাতির শিখাটি নেভানোর জন্য খুব জোরে ফুঁ দিন। যদি বারবার যথেষ্ট জোরে ফুঁ দিয়েও নেভাতে না পারেন, তাহলে আপনার মাস্কটি করোনা ভাইরাস আটকাতে বেশ কার্যকর বলে ধরে নেওয়া যায়।

যেসব উপাদান দিয়ে আপনি মাস্ক তৈরি করতে পারেন, সেগুলো হলো বিভিন্ন সুতি বা পলিয়েস্টার বা সিল্কের কাপড়। এগুলো নতুন হতেই হবে—এমন কোনো কথা নেই। আপনি আপনার বাসার পুরোনো কাপড় দিয়েই মাস্ক বানাতে পারেন। পুরোনো কাপড়ের মধ্যে পরিধেয় বস্ত্রাদি, তোয়ালে, বালিশের কভার, এমনকি ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাগও আপনি এর জন্য নিতে পারেন। শুধু শর্ত হচ্ছে কাপড় পরিষ্কার হতে হবে, ছেঁড়া অংশ বাদ দিতে হবে, কাপড়টা হতে হবে ঘন বুননের, সেই সঙ্গে এই মাস্কে একের অধিক স্তর রাখতে হবে। আমাদের এই প্রস্তাবনা কোনো হালকা বিষয় নয়। এর যথেষ্ট ও জোরালো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে এবং এই তথ্যগুলো বিভিন্ন দেশের গবেষণার ফলাফল থেকেই নেওয়া।

একটা আদর্শ মাস্ক কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে সবেগে বেরিয়ে আসা জলীয় বড় ড্রপলেটগুলো এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া ও কথা বলার সময় নিঃসৃত সূক্ষ্ম ড্রপলেট বা অ্যারোসল আটকে দেয়। এরকম আদর্শ মাস্ক নাক-মুখের চারপাশে লেগে থাকবে, মুখের ত্বকের সঙ্গে ফাঁকা থাকবে না বা এতে কোনো ছিদ্র থাকবে না। ফলে এসব ফাঁকা জায়গা বা ছিদ্র দিয়ে ড্রপলেট বা অ্যারোসল বেরিয়ে এসে অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে না। নিজেদের তৈরি কাপড়ের মাস্ক এরকম কার্যকর হবে কি? নিচের গবেষণা থেকে যে উত্তর পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, অবশ্যই হবে।

যেমন করোনা মহামারির শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে মাস্কের হঠাত্ দুষ্প্রাপ্যতার প্রেক্ষিতে সে দেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এ বছরের এপ্রিল মাসে কাপড়ের তৈরি মাস্ক ব্যবহারের পক্ষে সুপারিশ করে। তারা জনগণকে পুরোনো কাপড় দিয়ে নিজেদের মাস্ক নিজেরা কীভাবে তৈরি করবে—তাও প্রচার করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও গত জুন-জুলাই মাসে হাতে তৈরি কাপড়ের মাস্কের একটি ফর্মুলা দিয়েছে। সেটি হলো সবচেয়ে বাইরে থাকবে পলিয়েস্টার কাপড়ের একটি স্তর আর মাঝখানে ও সবচেয়ে ভেতরে থাকবে সুতি কাপড়ের দুটি স্তর। মোট তিন স্তরের এই মাস্কের ব্যাখ্যা হলো বাইরের পলিয়েস্টার স্তর ধুলাবালি আটকাবে কিন্তু সেগুলো এতে লেগে থাকবে না, যা সুতি হলে লেগে থাকত। মাঝের সুতি কাপড়ের স্তরটি বাতাসকে পুনরায় ছেঁকে ভাইরাস অণুজীবকে আটকে ফেলবে। তবু কিছু অণুজীব যদি মাঝের স্তরে না আটকায়, সেগুলো তৃতীয় অর্থাত্ সবচেয়ে ভেতরের সুতি কাপড়ের স্তরে আটকে যাবে।

গত আগস্ট মাসে ‘জার্নাল অব হসপিটাল ইনফেকশানস’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে ব্যবহূত ব্যাগের কাপড় দিয়ে মাস্ক বানিয়ে ব্যবহারে দেখা গেছে, এটি সার্জিক্যাল মাস্কের কার্যকর বিকল্প। এর পরে রয়েছে ব্যবহূত তোয়ালে, বালিশের কভার, সিল্ক এবং ১০০ শতাংশ সুতি টি-শার্টের তৈরি মাস্ক।

ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় এট উরবানা-চ্যাম্পেইন পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কাশি, হাঁচি ও কথা বলার সময় বেরিয়ে আসা ড্রপলেটস আটকাতে একেবারে নতুন ডিশক্লথ অর্থাত্ ধোয়া থালাবাসন মোছার জন্য ব্যবহূত তোয়ালের মতো কাপড় দিয়ে তৈরি মাস্ক পুরোনো ১০০ শতাংশ সুতি টি-শার্টের তৈরি মাস্কের চাইতে সামান্য কিছু বেশি কার্যকর। অর্থাত্ পুরোনো টি-শার্ট দিয়ে মাস্ক তৈরিতে কোনো সমস্যা নেই।

একই গবেষণায় বলা হয়েছে, অতি বেগে আসা ড্রপলেটস ঠেকাতে পুরোনো সিল্কের সার্ট দিয়ে তৈরি মাস্ক খুবই কাজের। সম্ভবত এর কারণ সিল্কের গায়ে আছে কিছু ইলেকট্রোস্টেটিক প্রপার্টি বা স্থির বিদ্যুত্, যা অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসকেও আটকে ফেলে। সুতি কাপড়ের গায়ে এই স্থির বিদ্যুত্ নেই। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, সিল্কের চারটি স্তর দিয়ে তৈরি করলে এসব মাস্ক ৮৮ শতাংশ ড্রপলেটস ও ৮৬ শতাংশ অ্যারোসল আটকাতে পারবে।

ডেমোক্রিটাস ইউনিভার্সিটি অব থ্রেস, ডিউক ইউনিভার্সিটি এবং পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড—এদের পরিচালিত গবেষণার গড় ফলাফলে দেখা গেছে, এন৯৫ মাস্কগুলো বড় ড্রপলেট ৯৯.৯ শতাংশ ও সূক্ষ্ম অ্যারোসল ৯৫ শতাংশ আটকাতে পারে। সার্জিক্যাল মাস্কের বেলায় এই ক্ষমতা যথাক্রমে ৯৮.৫ শতাংশ ও ৮৯.৫ শতাংশ। দুটি সুতি কাপড়ের লেয়ার বা স্তর বিশিষ্ট কাপড়ের মাস্ক আটকাতে পারে ৯৯.৫ শতাংশ ও ৮২ শতাংশ। পুরোনো তোয়ালে দিয়ে তৈরি করা মাস্ক ৯৮ শতাংশ ও ৭২.৫ শতাংশ এবং সুতির পুরোনো টি-শার্ট দিয়ে তৈরি মাস্ক আটকায় ৯৭ শতাংশ ও ৫১ শতাংশ। তাই তারা সুপারিশ করেছেন যে, হাসপাতাল বা কোনো চিকিত্সালয়ে এন৯৫ এবং সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। পক্ষান্তরে ঘর বা অফিসের ভেতর, কিংবা ভিড় বা জনসমাগমের স্থানগুলোতে এন৯৫ এবং সার্জিক্যাল মাস্ক পরা না গেলে কাপড়ের দুই-স্তরবিশিষ্ট মাস্কও পরা যেতে পারে। আর মাঠে-ময়দানে বা খোলা জায়গায় যেখানে জনসমাগম কম সেখানে পুরোনো তোয়ালে বা পুরোনো টি-শার্ট দিয়ে তৈরি মাস্ক অনায়াসেই ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিভিন্ন মাস্ক বিভিন্ন জায়গায় পরার সুপারিশের পেছনে মূল কারণটি হলো ‘ভাইরাল লোড’। যে এলাকায় করোনা ভাইরাস বেশি থাকার সম্ভাবনা, সেখানে অবশ্যই এন৯৫ বা সার্জিক্যাল মাস্ক পরতে হবে। তবে কেউ যদি সর্বত্রই এই দামি মাস্কগুলো পরতে চান, তাহলে আপত্তি নেই।

এন৯৫ ও সার্জিক্যাল মাস্ক ছাড়া ওপরে উল্লিখিত সবগুলো মাস্কই সাবান-পানি দিয়ে নিয়মিত ধুয়ে নেবেন। না ধুয়ে একদিনের বেশি এসব মাস্ক ব্যবহার করা যাবে না।

এন৯৫ ও সার্জিক্যাল মাস্ক সাবান-পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না। তাতে এগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হবে। এগুলোও একই মাস্ক প্রতিদিন পরা যাবে না। যারা নিয়মিত এসব মাস্ক পরতে চান, তারা এরকম চারটি মাস্ক কিনে ভেতরের অংশে নম্বর দিয়ে রাখুন এবং পর্যায়ক্রমে একেকটি নম্বরযুক্ত মাস্ক তিন দিনের বিরতি দিয়ে ব্যবহার করুন। তিন দিন ধরে ব্যবহার না করলে মাস্কে লেগে থাকা ভাইরাল অণুজীব এমনিতেই মারা যায় বলে বিভিন্ন গবেষকরা বলছেন।

যেহেতু আমাদের উপরি-উক্ত প্রস্তাবনায় অতি গরিব মানুষদেরও মাস্ক পরতে অসুবিধা হবে না, তাহলে আসুন নিজেকে ও অন্যকে নিরাপদ রাখতে সবাই মাস্ক পরতে শুরু করি এবং অন্যকেও পরতে উদ্বুদ্ধ করি।

লেখক :পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার;

সাবেক চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ;

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: