ঢাকা | শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু : সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনার পথিকৃৎ

amaderodhikarpatra@gmail.com | প্রকাশিত: ৫ জানুয়ারী ২০২১ ০০:০৩

amaderodhikarpatra@gmail.com
প্রকাশিত: ৫ জানুয়ারী ২০২১ ০০:০৩

 

|| একেএম কামাল উদ্দিন চৌধুরী ||
ঢাকা, ৪ জানুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামুদ্রিক সম্পদের বিশাল সম্ভাবনা উপলব্ধি করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দেশের সমুদ্রসীমা খাতের উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন। তাঁর দূরদর্শী নীতির অংশ হিসেবে সমগ্র বিশ্বকে সংযুক্ত করে সমুদ্রগামী পরিবহণের উন্নয়ন করা হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সমুদ্রবন্দরগুলো পুনঃনির্মাণ এবং রাশিয়ার মাইন ক্লিয়ারেন্স ফোর্সের সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন অপসারণ করেন।
দেশের সামুদ্রিক সম্পদের সম্ভাবনার সন্ধানে বঙ্গবন্ধু ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস্ এন্ড মেরিটাইম জোনস্ অ্যাক্ট ১৯৭৪’ প্রণয়ন ও কার্যকর করেন, যা বাংলাদেশের সমুদ্র ইতিহাসের মাইলফলক। প্রায় ৪৬ বছর আগে, ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের সাগর আইন সম্পর্কিত কনভেনশন গৃহীত হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু দেশে টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি বিকাশের আইনী কাঠামো ঘোষণা করেন। আসলে, টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস্ এন্ড মেরিটাইম জোনস্ অ্যাক্ট ১৯৭৪, দেশের সমুদ্র অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করেছিল।
সমুদ্র অর্থনীতি হচ্ছে সমুদ্র সম্পদ নির্ভর অর্থনীতি। সাগর জলরাশি ও এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগানোর অর্থনীতি। যার অর্থ হল, সমুদ্র থেকে যা-ই আহরণ করা হোক না কেন, যদি সেটা দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, তবে, সেটা ব্লু-ইকোনমির বা সুনীল অর্থনীতির পর্যায়ে পড়বে। সমুদ্র উপকূলে বহু মেগা সিটি এবং বাণিজ্য ও বাণিজ্যের কেন্দ্র গড়ে উঠেছে সমুদ্র পথের সুবিধাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-১৪ এ উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষ তাদের জীবিকার জন্য সরাসরি সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল। সমুদ্র অর্থনীতির মূল্য প্রতি বছর আনুমানিক মার্কিন ৩-৬ ট্রিলিয়ন ডলার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও গতিশীল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের নিরলস প্রয়াসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সামুদ্রিক বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বগর্ কিলোমিটার সীমানা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
আইনটি দেশের সামুদ্রিক সম্পদের যথাযথ পরিচালনা ও সুরক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, উপকূলীয় অঞ্চল পরিচালন, সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চল এবং নৌপরিবহন পরিচালন, সামুদ্রিক মাছ সংগ্রহ ও সমুদ্র শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পথ প্রশস্ত করেছে।
এই আইনটি সমুদ্র সুরক্ষা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিধিসহ দেশের বিভিন্ন সমুদ্র অঞ্চল নির্ধারণের জন্য একটি দুর্দান্ত রোডম্যাপ এবং সমুদ্রের মধ্যে এর অধিকার এবং দায়িত্বের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভিত্তি তৈরি করেছিলেন তার উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এখন সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বঙ্গোপসাগরকে অর্থনৈতিক বিকাশের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে সামুদ্রিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর তৎপরতা চলছে।
বাংলাদেশে সালিশী পদ্ধতির মাধ্যমে ২০১২ সালে মায়ানমারের সাথে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে। বঙ্গোপসাগরের নতুন অর্জিত অঞ্চলটি দেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সীমান্ত খুলেছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেনে, শামুক, সেল-ফিস, কাঁকড়া, হাঙ্গর, অক্টোপাস এবং অন্যান্য প্রাণী ছাড়াও এখানে প্রায় ৫০০ প্রকারের মাছ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের মোট ৮ মিলিয়ন টন মাছের মধ্যে বাংলাদশে প্রতি বছর মাত্র ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা হয়। মাছ ও অন্যান্য জীবন্ত প্রাণী ছাড়াও বাংলাদেশের সীমানায় গ্যাসক্ষেত্র থাকতে পারে। কারণ, মায়ানমার তার অঞ্চলটিতে একটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রে আবষ্কিার করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ-এর সমুদ্র অঞ্চল থেকে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আহরণ করতে সক্ষম হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও পর্যবেক্ষেণ করেছেন যে, এদেশের কাক্সিক্ষত, দু’অংকের জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ, অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিশাল এই সমুদ্র সম্পদকে অতিদ্রুত আমাদের অর্থনীতির মূল ধারায় সংযুক্ত করতে হবে।
তাদের মতে, সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
তারা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনিতীতে সমুদ্র সম্পদের অবদান মাত্র ৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অথবা ৬ শতাংশ, যা বৃদ্ধি করে কয়েকগুণ করা সম্ভব।
এ বিষয়ে আলাপকালে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বাসসকে বলেন, এ দেশের সমুদ্রসীমায় প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। পানির নিচের এসব সম্পদকে আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে আমাদের অর্থনীতির গতি অনেক বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, সমুদ্র অর্থনীতি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও ভিশন-২০৪১ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সমুদ্র অর্থনীতিকে মূল ধারার অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে আরও বেগবান করতে তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অথবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় একটি উইং খোলার পরামর্শ দেন।
সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছে দেশ। সাগরের বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের অফুরন্ত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানোর প্রক্রিয়া চলছে। সমুদ্র জয়ের পর সেই বিপ্লব বাস্তবায়নের রোডম্যাপ এগিয়ে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব:) মোঃ খুরশেদ আলম জানান, ইতোমধ্যে সামুদ্রিক অর্থনীতি বিকাশের জন্য ২৬টি কার্যক্রম চিহ্নিত করেছে সরকার। এগুলো হল: শিপিং, উপকূলীয় শিপিং, সমুদ্র বন্দর, ফেরীর মাধ্যমে যাত্রী সেবা, অভ্যন্তরীণ জলপথে পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ রিসাইক্লিং শিল্প, মৎস্য, সামুদ্রিক জলজ পণ্য, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তি, তেল ও গ্যাস, সমুদ্রের লবণ উৎপাদন, মহাসাগরের নবায়নযোগ্য শক্তি, ব্লু-এনার্জি, খনির (বালি, নুড়ি এবং অন্যান্য), সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদ, উপকূলীয় পর্যটন, বিনোদনমূলক জলজ ক্রীড়া, ইয়টিং এবং মেরিনস্, ক্রুজ পর্যটন, উপকূলীয় সুরক্ষা, কৃত্রিম দ্বীপ, সবুজ উপকূলীয় বেল্ট বা ডেল্টা পরিকল্পনা, মানব সম্পদ, সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং নজরদারি এবং সামুদ্রিক সমষ্টি স্থানিক পরিকল্পনা (এমএসপি)।
খুরশেদ আলম জানান, প্রত্যেকটি কার্যক্রমকে আরও কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং শিক্ষিত মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। যা অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে বিশ্বায়ন এবং প্রয্ুিক্তগত বিপ্লবে সহয়তা করবে।
তিনি বলেন, দক্ষ প্রকৌশলী, নৌবাহিনী, প্রযুক্তিবিদ, মৎস্য প্রযুক্তিবিদ, জৈব প্রযুক্তিবিদ এবং অন্যান্য বিভিন্ন পেশায় অভিজ্ঞদের হাত ধরে ব্লু-ইকোনমির সফলতা আসতে পারে।
বর্তমান সরকার ব্লু-ইকোনমির সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উপর বিশেষ নজর দিচ্ছে। সমুদ্র গবেষণা ও মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য সা¤প্রতিককালে সরকার বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং একটি মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছে।
দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা করা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অর্জনে সামুদ্রিক সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে, মোট উপকূলীয় অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক অঞ্চলটির সুরক্ষা নিশ্চিত করা , সামুদ্রিক পর্যটকদের জন্য সমুদ্রবান্ধব অবকাঠামো স্থাপন, আন্তর্জাতিক মাছ পাচারকারী ও জলদস্যুদের হাত থেকে অঞ্চলটিকে রক্ষা করা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখা, জীববৈচিত্র্যের টেকসই ব্যবহার, সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় বাস্তুসংস্থান বজায় রাখা, ম্যানগ্রোভ এবং সমুদ্র ঘাস সংরক্ষণ, জলবায়ুু পরিবর্তন ও কার্বন নিঃসরণ পরিচালনা করা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের স্তর ও তাপমাত্রা সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান ও পরিবর্তন বজায় রাখার চ্যালেঞ্জগুলিও দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: