ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের আশার আলো শ্রবণবান্ধব পাঠ্য বই

amaderodhikarpatra@gmail.com | প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৭:০১

amaderodhikarpatra@gmail.com
প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৭:০১

 
sharethis sharing button

 

ঢাকা, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১ :  দেশে হাজার হাজার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে যাদের পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা। তাদের জন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বান্ধব ডিজিটাল উপকরণ সামগ্রীর সমন্বয়ে তৈরি করা পাঠ্যবই যেন আশীর্বাদের ডালি। তাদেরই একজন  চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মোহাম্মদ শাকিল খান। এগারো বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। একজন  শিক্ষার্থী  হিসেবে বিশেষ করে সহজলভ্য   অধ্যয়ন সামগ্রীর অভাবে তাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। শিক্ষা জীবনে মাধ্যমিক  স্তরে তিনি কোন ডিজিটাল উপকরণ পান নি। তাই শাকিলকে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে নানান সমস্যায়  পড়তে হয়েছে।
অনেক প্রতিকুল  পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই শাকিল আজ চট্টগ্রাম  বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।  দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত শাকিল বলেন,‘আমি ছোটবেলা থেকেই চোখের সমস্যায় ভুগছি। কিন্তু এগারো বছর বয়সে সমস্যাটি প্রকট হয়ে ওঠে। সাতকানিয়া উপজেলায় নিজ  গ্রাম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে আমি চট্টগ্রাম শহরের একটি বিশেষায়িত স্কুলে (সরকারি মুরাদপুর স্কুল ফর দ্য ব্লাইন্ড) অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হই। অষ্টম  শ্রেণী শেষ করে আমি ‘রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই’। নানাবিধ প্রতিকুলতা সত্বেও  পরিবারের  সদস্যদের কাছ থেকে  সমর্থন ও সহায়তা পাওয়ায় শাকিল  তার বাবা-মা, বোন এবং ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তারা সমস্ত বই এবং ক্লাস নোট রেকর্ড করে দিয়ে  সেসময় আমাকে সহায়তা করেছিলেন। আমার বাবা-মায়ের কষ্টের কোন সীমা ছিলনা।  দৃষ্টি প্রতিবন্ধী একটি শিশুর শিক্ষা অব্যাহত রাখার জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। তার জন্য চাই কিছু প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন উপকরণ।  যে সব অভিভাবক তাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী  সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান তাদের শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক চাপের সম্মুখীন হতে হয়।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন উপকরণ পাওয়া ছিল  একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এটি তার পরিবারকে অষ্টম  শ্রেণি পর্যন্ত সমস্যায় ফেলেছিল। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি অডিও ফরম্যাটে অর্থ্যাৎ শ্রবণবান্ধব পাঠ্যবই হাতে পান। পরে তিনি জানতে পারেন যে এগুলোকে “ডেইজি-স্ট্যান্ডার্ড ডিজিটাল টকিং বুক” বলা হয়।
নাগরিক জীবনকে সহজ ও উন্নত করতে সরকারের এটুআই কর্মসূচি কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ লক্ষ্য অর্জনের অংশ হিসেবে এটুআই প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকে সহজ করতে ডিজিটাল টকিং বইসহ বিভিন্ন নতুন উপকরণ উদ্ভাবন করছে।  ডিজিটাল কথা বলার বইগুলো হচ্ছে  শ্রবণযোগ্য উপকরণ যা মূদ্রণ এবং শেখার অক্ষমতাসহ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অডিও সংস্করণে পাঠ্যক্রম সরবরাহ করে। শ্রবণযোগ্য  তথ্য প্রয়োজন এমন সবার জন্যই ডিজিটাল কথা বলার বই এই ‘টকিং বুক’। এর মাধ্যমে পাঠকরা অডিও চালাতে পারে এবং একই সাথে সংশ্লিষ্ট পাঠ্যসূচি দর্শন ও হাইলাইট করতে পারে। যা বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সহজ করেছে।
এর মাধ্যমে এখন শাকিলের শিক্ষাজীবনও অনেক সহজ হয়েছে।  এখন নিজের পড়ার উপকরণ পেতে স্মার্টফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সর্বক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে শাকিল বলেন,  সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের পঠন সামগ্রী তার কঠিন শিক্ষা  জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। ২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ ৫  পেয়ে উত্তীর্ণ হন শাকিল। অক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই করে পড়াশোনার জন্য সংগ্রামরত অন্যান্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শাকিলের এ অর্জন একটি  দৃষ্টান্ত তৈরী করেছে।
এটুআই কার্যালয় সুত্র জানায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি দল ওপেন সোর্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য (ডিএআইএসওয়াই) স্ট্যান্ডার্ড ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বই, ই-বুক এবং ডিজিটাল  ব্রেইল বই তৈরি করেছে। এসব বই ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। ডিএআইএসওয়াই  কনসোর্টিয়াম, অ্যাক্সেসিবল বুকস কনসোর্টিয়াম এবং ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) প্রযুক্তিগত  এবং   এটুআই তহবিল থেকে  সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে প্রকল্পটি। 
এটি সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তককে ( গ্রেড ১ থেকে ১০) সাশ্রয়ী ডিএআইএসওয়াই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ফরম্যাটে রূপান্তরিত। যার মাধ্যমে ব্রেইল, টেক্সট, অডিও বুক বা ই-বুক তৈরি সহজ করে তুলেছে।
মাল্টিমিডিয়া টকিং বইগুলোর বিকাশ, উদ্ভাবনী মডেল এবং অনুশীলনের সাথে ডিজিটাল প্রকাশনাগুলোর সহজলভ্যতা  সম্প্রসারণের কারণে  প্রকল্পটি খ্যাতি ও  বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেছে।
এসব পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে উলে¬খযোগ্য হচ্ছে; ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন  সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) পুরস্কার, ২০১৭; জিরো প্রজেক্টস অ্যাওয়ার্ড অন ইনক্লুসিভ এডুকেশন (২০১৬); লন্ডন বই মেলায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৫-এ অ্যাক্সেসিবল পাবলিশিং ইনিশিয়েটিভের জন্য অ্যাক্সেসিবল বুকস কনসোর্টিয়াম অ্যাওয়ার্ড।
তথ্য সোসাইটি ইনোভেশন ফান্ড (আইএসআইএফএশিয়া) পুরস্কার, ২০১৪ ছিল ডিজিটাল টকিং বুক প্রকল্পের জন্য প্রথম মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই তহবিল এবং প্রাপ্ত পুরষ্কার মুলত  সমস্ত শিক্ষার সহজলভ্যতা তৈরিতে আরও প্রচেষ্টা এবং উন্নয়নকে আরো বেশি  সুরক্ষিত করে তুলেছে।
বাসসের সাথে আলাপকালে, এটুআই-এর প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, এটুআই প্রকল্পটি  দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য করতে নিয়মিত কাজ করছে।
এই ডিএআইএসওয়াই ডিজিটাল টকিং বই পড়ার জন্য স্বল্পমূল্যের ডিজিটাল  ব্রেইল ডিসপ্লে এবং কম দামের  ডিএআইএসওয়াই মাল্টিমিডিয়া বই স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। 
তিনি বলেন, সরকার সমাজের ‘ধারনানির্ভর দায়বদ্ধতার’ পরিবর্তে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে চায়। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সকলের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা গেলে, তা বাংলাদেশের মানবকেন্দ্রিক এবং টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে।

এ কে এম কামাল উদ্দিনি চৌধুরী

বাসস



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: