হাওর-বাওর ও সমতলভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জ। মহাবীর ঈশা খাঁ'র স্মৃতি বিজড়িত এ কিশোরগঞ্জে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা। ষোড়শ শতাব্দী অর্থাৎ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি নারী কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি ও দেশের প্রাচীন ও সবচেয়ে বড় শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান । এছাড়াও রয়েছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি অর্থ আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ ও গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়িসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা। এ ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখার জন্য প্রতিদিনিই দেশবিদেশ থেকে ছুটে আসেন অনেক পর্যটক।
কবি চন্দ্রাবতী মন্দিরঃ
কবি চন্দ্রাবতী বাংলা ভাষার প্রথম নারী কবি হিসাবে স্বীকৃত। চন্দ্রাবতী ১৫৫০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দ্বিজ বংশীদাস বিখ্যাত কাব্য ‘মনসামঙ্গল’ এর রচয়িতা এবং কবির মায়ের নাম সুলোচনা। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে পাতোয়াইর গ্রামের ফুলেশ্বরী নদীর পাশে কারুকার্য মন্ডিত দুটি শিবমন্দির রয়েছে। এ মন্দিরই কবি চন্দ্রাবতী শিব মন্দির বা কবি চন্দ্রাবতী মন্দির হিসাবে খ্যাত। ধারণা করা হয় এ মন্দিরগুলোর সাথে কবির জীবনের বিভিন্ন ঘটনার অনেক সম্পৃক্ততা রয়েছে। মন্দিরের কাছেই দর্শনার্থীদের বসার জন্য ব্যবস্থা করা রয়েছে। প্রতিদিন বিকেল বেলা ও বিভিন্ন ছুটির দিনে অনেক মানুষ কবি চন্দ্রাবতী মন্দির দেখতে আসেন। মন্দিরের পাশেই রয়েছে কবি চন্দ্রাবতীর প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি।
কবি চন্দ্রাবতী মন্দিরটি অষ্টভুজাকৃতির এবং এর উচ্চতা প্রায় ৩২ ফুট। মন্দিরের নিচতলায় আছে একটি কক্ষ রয়েছে, কক্ষের ভেতরে ৭টি কুলুঙ্গি রয়েছে। মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় পোড়ামাটির সুদৃশ্য কারুকার্য সম্বলিত একটি প্রশস্ত কুলুঙ্গি আছে। দ্বিতীয় তলা থেকেই মন্দিরটি ক্রমশ সরু হয়ে উপরে ৩২ ফুট পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ চন্দ্রাবতী মন্দিরের সংস্কার কাজ করে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানঃ
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে নরসুন্দা নদীর তীরের কোল ঘেষে পূর্বে অবস্থিত বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ ময়দান। ১৮২৮ সাল থেকে এ মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ৭ একর আয়তনের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে মোট ২৬৫ সারি আছে এবং প্রতি সারিতে প্রায় ছয়-সাতশ করে মুসল্লি দাঁড়াবার ব্যবস্থা আছে। সেই হিসেবে মাঠে এক লাখ ষাট থেকে আশি হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের সময় দেখা যায় মাঠে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় চারপাশের খোলা জায়গা, আশপাশের সড়ক, আশেপাশের ঘরবাড়ির উঠানেও নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। এভাবে প্রায় তিন লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ পড়ে থাকেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ও বিদেশ থেকে অনেক মুসল্লির আগমনে এ মাঠের ঈদের জামাতের মর্যাদা অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি বহু পর্যটক এ অভূতপূর্ব মহামিলনের সময়টি দেখার জন্যে শোলাকিয়ায় উপস্থিত হয়।
মাঠের ইতিহাস:
ইসলামের ঐশী বাণী প্রচারের জন্য সুদূর ইয়েমেন থেকে আগত শোলাকিয়া ‘সাহেব বাড়ির’ পূর্বপুরুষ সুফি সৈয়দ আহমেদ তার নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামাতের আয়োজন করেন। ওই জামাতে ইমামতি করেন সুফি সৈয়দ আহমেদ নিজেই। অনেকের মতে, মোনাজাতে তিনি মুসল্লিদের প্রাচুর্যতা প্রকাশে ‘সোয়া লাখ’ কথাটি ব্যবহার করেন। আরেক মতে, সেদিনের জামাতে ১ লাখ ২৫ হাজার (অর্থাৎ সোয়া লাখ) লোক জমায়েত হয়। ফলে এর নাম হয় ‘সোয়া লাখি’। পরবর্তীতে উচ্চারণের বিবর্তনে শোলাকিয়া নামটি চালু হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, মোগল আমলে এখানে অবস্থিত পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে সোয়ালাখিয়া সেখান থেকে শোলাকিয়া। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে স্থানীয় হয়বতনগর দেওয়ান পরিবারের অন্যতম দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বদান্যতায় এ মাঠের কলেবর বৃদ্ধি পায় এবং এবং এর পরিধি বিস্তৃতি লাভ করে। দেওয়ান মান্নান দাদ খান ছিলেন বীর ঈশা খাঁর অধঃস্তন বংশধর।
পাগলা মসজিদ:
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায় আড়াইশ বছরের পুরানো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ অবস্থিত। পাগলা মসজিদ মুসলিম অমুসলিম ধর্ম ও নির্বিশেষে সকলের কাছেই একটি বিস্ময়। মূলত বিপুল পরিমানের টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনা রুপা দান ও মনোবাসনার চিঠি পাবার জন্যে এ মসজিদ সর্বাধিক আলোচিত। এ মসজিদে নামাজ পড়তে ও দান করতে প্রতিদিনই দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে। বিশেষ করে শুক্রবারে ১২ থেকে ১৫ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এ মসজিদে।
জনশ্রুতি অনুসারে, কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক হয়বতনগর জমিদার বাড়ির ঈসা খানের বংশধর দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা সাহেব নামক একজন আধ্যাতিক ব্যক্তি নরসুন্দা নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। পরবর্তীতে স্থানটিতে মসজিদটি নির্মিত হয়। জিল কদর পাগলার নামানুসারে মসজিদটি 'পাগলা মসজিদ' হিসেবে পরিচিতি পায়।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকার সায়দাবাদের গোলাপবাগ থেকে কিশোরগঞ্জ গাইটাল বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বাসে জনপ্রতি ভাড়া ৩৫০ টাকা, গুলিস্তান থেকে জনপ্রতি বাস ভাড়া ৩৫০ টাকা ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে জনপ্রতি ভাড়া ৩৫০ টাকা ভাড়ায় কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসা যাবে। এছাড়া ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জ আসতে (ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট ভেদে) ভাড়া ১৫০- ৩৭০ টাকা লাগতে পারে। (টিকেটের অনলাইন চার্জসহ)।
কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা ভাড়ায় কবি চন্দ্রাবতী বাড়িতে যাওয়া যায়। কবি চন্দ্রাবতী মন্দিরের আশেপাশে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। তবে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে বেশ কিছু ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া অনুমতি সাপেক্ষে জেলা সদরের সরকারি ডাক-বাংলোতে থাকতে পারবেন। এছাড়াও খাবারের জন্য বেশ কিছু ভালোমানের হোটেল রয়েছে এগুলোতে হাওরের মাছসহ বিভিন্ন রকমের খাবার খাওয়া যাবে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ও পাগলা মসজিদ কিশোরগঞ্জ শহরেই তাই এগুলো দেখতে বাসস্ট্যান্ড বা রেলস্টেশন থেকে ৩০-৪০ টাকায় যাওয়া যাবে।
রাতে থাকতে হলে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের আবাসিক হোটেলগুলোতে থাকতে হবে। এগুলোতে জনপ্রতি ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে।
//এসকে রাসেল//
বাসস

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                            
                                            
                                            
                                            
                                            
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: