odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Thursday, 6th November 2025, ৬th November ২০২৫

অস্তিত্বের সংকটে বাংলাদেশের সুয়েজ খাল: স্রোতহারা নদীমাতৃক জনপদের কান্না

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৬ September ২০২৫ ০৭:০৭

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৬ September ২০২৫ ০৭:০৭

উপসম্পাদকীয়

বাংলাদেশের সুয়েজ খাল—এই নামেই একসময় পরিচিত ছিল মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুরের তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল। সেই খাল আজ যেন স্মৃতিভ্রষ্ট এক দেহ, বুকজুড়ে শুকনো বালু, ভাঙা চরের ক্ষতচিহ্ন। একদিন যে খালে পালতোলা নৌকা ভেসে চলত, স্টিমারের বাঁশির সুরে মুখর থাকত জনপদ, আজ সেখানে ছোট্ট এক ডিঙ্গিও চালানো দায়। নাব্যতা হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে পানির প্রবাহ, থমকে আছে গোটা জনপদের প্রাণরেখা।

পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি—চার মহীরুহ নদীর কোলঘেঁষে জন্ম নিয়েছিল মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর। নদী আর খালের জাল বোনা এই জনপদকে একসময় বলা হতো নদী বিধৌত পবিত্র ভূমি। ভরা বর্ষায় আড়িয়াল বিলের ১৩ হাজার একর জলরাশি যেন ছোট্ট এক সমুদ্র, আবার শীতে সেই বিস্তীর্ণ ভূমি সোনালি ফসলের মাঠে রূপ নিত। এই জনপদের জীবন, অর্থনীতি, সংস্কৃতি—সবকিছুই নির্ভর করত নদী-খালের অনবরত স্রোতের ওপর। সেই স্রোত শুকিয়ে যাওয়ায় আজ যেন গোটা জনপদই শোকে ডুবে আছে।

তালতলা-গৌরগঞ্জ-ডহরী খাল একসময় ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নৌবাণিজ্যের মহাসড়ক। ফরিদপুর, বরিশাল কিংবা কুষ্টিয়া থেকে আসা মালবাহী নৌকা এই খাল বেয়ে সহজেই পৌঁছে যেত ঢাকা। ঘাটে ঘাটে জমত মানুষের ভিড়, নৌকার হাটবাজারে লেনদেন চলত, গরুর গাড়ি থেকে নামানো হতো বোঝাই শস্য। সেই চিরচেনা দৃশ্য এখন শুধু প্রবীণদের স্মৃতিতে টিকে আছে। শুকনো মৌসুমে খালের বুকজুড়ে ফেটে যাওয়া মাটি, বর্ষায় সামান্য পানি জমলেও আর ওঠে না আগের মতো জোয়ার।

খাল শুকিয়ে যাওয়ার অর্থ কেবল নৌপথ হারানো নয়; কৃষিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পলি জমছে না, ফলে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা। সেচের পানি না পেয়ে ফসল শুকিয়ে যায়। খালপাড়ের এক প্রবীণ কৃষক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আলুর জমিতে পানি দিতে পারি না। খাল বাঁচলে ফসল বাঁচবে, মানুষও বাঁচবে।” তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় পুরো প্রজন্মের বেদনা।

কৃষির পাশাপাশি ভাঙনের ভয়ও জেঁকে বসেছে মানুষের মনে। ডহরী আর বড়মোকামের মানুষ প্রতিদিন আতঙ্কে দিন কাটায়—কবে পদ্মার ঢেউ এসে গিলে নেবে তাদের ঘরবাড়ি। খালের মুখে জমে থাকা পলি আর বছরের পর বছর অবহেলা তার স্রোতধারাকে মেরে ফেলেছে, ফলে ভাঙন ঠেকানোর ক্ষমতাও শেষ হয়ে এসেছে। মানুষের চোখে-মুখে ভয়, তবু বুকের ভেতরে একটুকরো আশা—একদিন আবার খাল খনন হবে, স্রোত ফিরে আসবে, পদ্মার ঢেউ ঠেকাতে খাল আবার বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে।

একসময় ধলেশ্বরী আর ইছামতির স্রোত খালের প্রাণে প্রাণ সঞ্চার করত। আজ তারাও মৃতপ্রায়। যে নৌঘাটে ভিড়ত স্টিমার, লঞ্চ আসত দিন-রাত, সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ ঘাট, স্তব্ধ জলে ঝুলে আছে ইতিহাস।

তবুও আশার প্রদীপ নিভে যায়নি। প্রবীণ থেকে তরুণ—সবাই একসুরে বলছে, খালটিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। স্রোত যদি আবার বইতে শুরু করে, তবে শুধু নৌপথই নয়, কৃষির প্রাণও ফিরবে, থামবে ভাঙনের হাহাকার।

বাংলাদেশের সুয়েজ খাল আজ স্রোতহীন হলেও, তার গল্প নদীমাতৃক বাংলার বুকজুড়ে এখনো বহমান। মানুষের আকুল প্রার্থনা—খালটিকে আবার জাগিয়ে তোলা হোক, যেন স্রোতের সঙ্গে ফিরে আসে জনপদের হাসি, ফসলের গান আর নদী-বিধৌত জীবনের চিরচেনা ছন্দ।

 — লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: