ঢাকা | রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ধর্ষকেরা আঁধার ঘরের কালো বিড়াল

Admin 1 | প্রকাশিত: ৫ মে ২০১৭ ২০:৫৫

Admin 1
প্রকাশিত: ৫ মে ২০১৭ ২০:৫৫

গৌরীপুর থানার ব্যারাকে ২ এপ্রিল নিজের কক্ষে শরীরে আগুন দেন কনস্টেবল হালিমা বেগম (২৫)। ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। হালিমা মৃত্যুর আগে তাঁর ডায়েরি ও একটি চিরকুটে আত্মহত্যার কারণ লিখে যান। হালিমা লিখেছেন, ‘আমার মরে যাওয়ার একমাত্র কারণ এসআই মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম আমাকে ধর্ষণ করেন। আমার অভিযোগ অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গ্রহণ করেন না।’
খুলনায় মা ডেকে ঘনিষ্ঠতা তৈরির পর বাসায় নিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় এক কলেজছাত্রী গত ১৫ মার্চ এনামুল হক টিটোর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। ওই দিনই এনামুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৩ এপ্রিল এনামুলকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সকাল সাড়ে ১০টায় মামলা এজলাসে ওঠার কথা, কিন্তু আইনজীবীর কোনো খোঁজ নেই। বারবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আসছি-আসছি বলে সময়ক্ষেপণ। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পর আইনজীবী যখন আদালতে হাজির, ততক্ষণে জামিন পেয়ে গেছেন আসামি। সংবাদমাধ্যমে এ খবর ভালো করেই ছাপা হয়েছে।
ওপরের দুটি ঘটনাই সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে উঠে আসে। ধর্ষণ যতটা না যৌনতার প্রকাশ, তার থেকেও অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা। ধর্ষণ করলে পুরুষ মনে করে পৌরুষের পরিচয় দেওয়া গেল। তাই অন্যায় অপরাধ জেনেও তারা ধর্ষণ করে। ধর্ষণ নারীর অধস্তনতা এবং নিপীড়নের ধারাবাহিকতা। একটা সমাজ কতটা সভ্য, তা নির্ভর করে ওই সমাজের মানুষ কতটা নিরাপদ, তার ওপর। ধর্ষণ সংবাদের শিরোনামই বলে দেয়, এটা এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অনেকাংশেই মনে হয় ‘নিরবিচ্ছিন্ন’ ঘটনা। আজ ৫ মে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘জুরাইনে বিদ্যালয়ে আটকে কিশোরীকে গণধর্ষণ’ শীর্ষক খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে সংবাদমাধ্যমে রাজধানীতে দুটি শিশুকে ধর্ষণ, উত্তরায় কর্মজীবী কিশোরীকে গণধর্ষণ, পোশাকশ্রমিককে ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে।
যতটা না নারীর প্রতি কিংবা নারীর শরীরের প্রতি সহিংসতা বা কৃত অপরাধ; তার চেয়েও বেশি ধর্ষণকে সামাজিক নৈতিকতা, নারীর শারীরিক পবিত্রতা, সম্মান, সম্ভ্রম, সতীত্বের কাঠামোর মামলা। এবং এই বাস্তবতায় ধর্ষণ মামলাগুলো প্রায়ই ভিকটিমের ‘চরিত্রহরণের’ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ভিকটিমের বিগত যৌন ইতিহাস নিয়ে কথোপকথন ও জিজ্ঞাসাবাদের সংস্কৃতি চালু থাকার দরুন শতকরা ৯০ ভাগ মেয়েশিশু ও নারী ধর্ষণ মামলার অভিযোগ আনতে ভয় পান। কেউ কেউ মামলা মাঝপথে বন্ধ করে দেন। অনেক সময় আসামিপক্ষের উকিলের জেরায় ভিকটিম নারী মানসিক, সামাজিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন, এমনকি আত্মহননের পথ বেছে নেন। মোট ফলাফলে ধর্ষণের অভিযোগ বিচারের বাইরে রয়ে যায়। ধর্ষণের শিকার মেয়েশিশু ও নারীদের ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’ নামে একটি বিতর্কিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এখনো বহাল আছে।
আইন কমিশনের দেওয়া এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে নারী, শিশু-সংক্রান্ত মামলাসহ প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষ করার মতো। ডিফেন্স ল’ইয়ারের মানসিকতাও এ ক্ষেত্রে দায়ী। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সামাজিক অবস্থানের কারণে ধর্ষণের শিকার নারীদের অর্ধেকের বেশি আইনের আশ্রয় না নিলেও নথিভুক্ত ব্যক্তিদের ৮৫ ভাগ পায় না ন্যায্য বিচার। ফলে এসব নারীর জীবনে সামাজিক নিগ্রহের পাশাপাশি ঘটছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
ধর্ষণ নারীকে অবদমিত রাখার প্রধান অস্ত্র। শুধু তাই নয়, ধর্ষণ নারীকে নিয়ন্ত্রণের নিরাপদ অব্যর্থ অস্ত্রও বটে। কেননা, সমাজ নারীকে সত্বীত্বের নির্মিত মিথ্যা ধারণা দিয়ে বড় করে। একটি মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে বড় করে যে ‘নারীর জীবনে সতীত্বই আসল’। প্রতিটি ধর্ষণের দায় নিতে হয় ধর্ষিতাকে। এ সমাজে ধর্ষকের লজ্জা নেই, সব লজ্জা ধর্ষিতাদের। নারীকে বোঝানো হয়, অপমানের জীবনের চেয়ে মৃত্যুই বাঞ্ছনীয়। ধর্ষণের দায় থেকে অনেক সময় মুক্তির পথ হয়ে ওঠে ‘আত্মহত্যা’।
নারীরা যৌনবস্তু নন। একজন মেয়েকে কেবল শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও ধর্ষিত হতে হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সেই সংজ্ঞা অনুসারে কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের বেশি বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা ব্যতিরেকে শারীরিক সম্পর্ক করলে তিনি সেই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।
‘১৪ বছরের কম বয়সী, ঋতুমতী হয়নি এমন মেয়েদের প্রতি যাদের যৌন আকর্ষণ, তারা মানসিক রোগী,’ ভিয়েনার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ক্রাফট এবিং ১৮৮৬ সালে এই মন্তব্য করেন। সমাজে বিভিন্ন ধরনের ধর্ষক আছে। যারা পিডোফাইল, তারা শুধু শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে।
কেবল যৌনতার কারণেই কেউ ধর্ষণ করে না। এটা আধিপত্য বিস্তার করার অস্ত্র; একধরনের যৌনবিকৃতি। যৌননিপীড়নের কারণে নারীরা শুধু শারীরিকভাবেই আক্রান্ত হন না, বিষণ্নতায়, হতাশায় এবং ভীতিতেও ভোগেন।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। প্রতিবছর অন্তত ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা। এদের মধ্যে ৬০ ভাগই শিশু। এর মধ্যে গণধর্ষণ বেড়েছে ১৪ ভাগ। আর ঘটনাগুলোর ৮০ ভাগই নির্যাতিত হয় প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের দ্বারা। সরকারের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের পরিচালকেরা মনে করেন, নির্যাতনের সংখ্যা আসলে বাড়েনি, বরং মানুষের প্রকাশ বেড়েছে। মিডিয়াতে সংবাদগুলো প্রচার হওয়ায় মানুষ জানতে পারছে। বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া অপরাধের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সংখ্যার দিক থেকে মাদকের পর দেশে সব থেকে বেশি অপরাধ ঘটে শিশু ও নারী নির্যাতনের।
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না। পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, স্তরতন্ত্র, ভুল শিক্ষা, খারাপ সঙ্গ, নারীবিদ্বেষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারীকে নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা পুরুষকে ধর্ষক বানায়। মনোবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, ধর্ষণের মধ্য দিয়ে পুরুষ তার আধিপত্যের বাসনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
শাস্তি দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা কঠিন। ধর্ষকেরা আঁধার ঘরের কালো বিড়াল। তাদের খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়! ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে ধর্ষণের মূল কারণগুলো নির্মূল করতে হবে। বিচারে ধর্ষকদের ফাঁসি চাওয়া হয়। এটা অনেক সহজ। তবে ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।

সৈয়দা আখতার জাহান

সহকারী অধ্যাপক,

সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ,

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: