ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস: নেপথ্যের নায়ক শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি

odhikarpatra | প্রকাশিত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:০৮

odhikarpatra
প্রকাশিত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:০৮

 

১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস যার নেপথ্যের নায়ক শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি।বঙ্গবন্ধুর বড়বোন শেখ আছিয়া বেগমের বড় ছেলে
শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মণি।

১৯৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল সেই আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ছ'মাস বিনা বিচারে আটক থাকার পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।

গণবিরোধী শিক্ষানীতি ও ছাত্রদের উপর দমন নীতির প্রতিবাদে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তদানীন্তন কুখ্যাত গভর্নর মোনায়েম খানের হাত থেকে ডিগ্রি সার্টিফিকেট না নেয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে শেখ ফজলুল হক মণির এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়। পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিনি ডিগ্রি ফিরে পান। এর কিছুদিন পরেই তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তদানীন্তন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে ১৯৬৫ সালের শেষ নাগাদ কারাগারে আটক রাখা হয়।

শেখ ফজলুল হক মণির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ১৯৬৬ সালের ৭ জুনে ৬ দফার পক্ষে হরতাল সফল করে তোলা। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি– আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ঢাকা- নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের পথসভা ও গেট সভা করতে বললেন এবং সমস্ত ঢাকাকে ১১টা ভাগে ভাগ করে দায়িত্ব বণ্টন করে দিলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে মুনিরুল ইসলাম, আলী আহমেদ (চুনকা ভাই), গোলাম মূর্শীদ (এস.সি.এ), আনসার সাহেব, চকবাজারের রিয়াজুদ্দিন ও নাজিরা বাজারের সুলতান সাহেব, ফজলুর রহমান, নিজাম সাহেব পুরাতন ঢাকার। নতুন ঢাকার কর্মীদের পরিচালনা জন্য আনোয়ার চৌধুরী, ময়েজউদ্দিন আহমেদ, নুরুল ইসলাম। মিসেস আমেনা বেগম ও গাজী গোলাম মোস্তফা সবকিছু দেখা শুনা করার দায়িত্ব দিলেন। ছাত্রদের ১১টা গ্রুপের সার্বিক নেতৃত্বের ভার দিলেন মিজান চৌধুরীকে। তেজগাঁও, আদমজী পোস্তগোলাসহ শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করেছিলেন। এমনকি মানিক মিয়া বললেন, ইত্তেফাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি পিছপা হবেন না। তিনি আরো আশ্বাস দিলেন, হরতালের কর্মসূচি যাতে করে সব কাগজে ছাপা হয় তার জন্য প্রভাব বিস্তার করবেন। বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর কি হলো? গভীর রাতে পিছনের দেওয়াল টপকিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তার মামিকে সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে বললেন, রাতের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নিকট খবর পৌঁছে দাও হরতাল হবেই। ওই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম পিছিয়ে যেত। মোনায়েম খান শেখ মনিকে গ্রেফতার করেন; তিনি মুক্তি পান ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর। ( সূত্র: ৭ জুন ১৯৭২ বাংলার বাণী)

শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচির অন্যতম প্রণেতা। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী শেখ ফজলুল হক মণি সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক-বিমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ ভাগ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। (স্মরণীয়-বরণীয়, ব্যক্তিত্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-পৃ:৪৬১)।

স্বাধীনতার পূর্বে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’, যেটি ‘নিউক্লিয়াস’ নামে পরিচিত ছিল, সেই পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। ১৯৭১ সালে মে মাসের দিকে এই পরিষদ বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট ‘মুজিব বাহিনী’ নামে ভারতের দেরাদুনের তান্দুয়া নামক পাহাড়ি স্থানে চারটি সেক্টরে গঠিত হয়। তিনি পূর্বাঞ্চলের যৌথ কমান্ডার ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি হেলিকপ্টারে মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান, পিভিএসএম, এভিএসএম-সহ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শনে আসতেন। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৬টি ব্যাচে ১০,০০০ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ‘মুজিব বাহিনী’ নামটি নামকরণের ব্যাপারে জেনারেল উবান প্রথম প্রস্তাব করেন। তিনি মুজিববাহিনীর চার নেতার নাম দিয়েছিলেন ‘অবিচ্ছেদ্য চার’। মেজর জেনারেল উবানের স্মৃতিচারণে দেখা যায়, ‘প্রচণ্ড আত্মশক্তিতে বলীয়ান এই মানুষটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় অসুস্থ থাকতেন। কিন্তু কাজ করা বন্ধ করতেন না। অদম্য সাহসের অধিকারী এই লোকটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ ভূমিতে প্রকৃত যুদ্ধের সময় আমার সঙ্গে ছিলেন। মণির সঙ্গে সাক্ষাতে আমি বুঝেছিলাম তিনি প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী অমিত আত্মত্যাগের মনোভাবসম্পন্ন। তাদের কেন্দ্রে প্রশিক্ষিত এক ছোট সুদর্শন বালকের ওপর অসহ্য নির্যাতন হয়েছিল। ঢাকার পতনের পর শেখ ফজলুল হক মণি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি মুজিব বাহিনীর একটি অসুস্থ বালককে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে যেতে পারেন কিনা। পরে উবান যখন ঢাকায় আসেন, তখন দেখেন শেখ মণি কম বয়সী ছেলেকে সাথে নিয়ে তার আকাশযানের দিকে আসছেন। তিনি বুঝতে দেরি করলেন না, এই সেই ছেলে যাকে শেখ মণি
ঢাকায় পাঠিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। এই হলো শেখ
মণি যার ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল মনুষ্যত্ববোধ।

মেজর জেনারেল উবান বলেন, উচ্চ সংস্কৃতিবান মানুষটি (শেখ মণি)কথা কম বলতেন। তাঁর হাসি বের হয়ে আসতো একদম সরাসরি হৃদয়ের ভেতর থেকে এবং সে হাসি ছিল সংক্রামক। তাঁকে হাসতে দেখে আমার ভালো লাগতো।

শেখ ফজলুল হক মণি বাঙালি সংস্কৃতির উপাসক ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক বাংলার বাণী, বাংলাদেশ টাইমস এবং বিনোদন পত্রিকা সাপ্তাহিক সিনেমার সম্পাদক ছিলেন। শাপলা কুঁড়ির আসরের প্রতিষ্ঠাতা। তার রচিত বেশ কিছু রাজনৈতিক উপন্যাস পাঠক সমাজে-সমৃদত হয়েছে। একটি উপন্যাস অবলম্বনে ‘অবাঞ্ছিত’ নামে একটি জনপ্রিয় টেলিফিল্মও তৈরি হয়েছে। এছাড়া "গীতারায়" নামে গল্পগ্রন্থ বেশ জনপ্রিয় ছিল।

শেখ ফজলুল হক মণি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থির যুবসমাজকে সৃজনশীল খাতে প্রবাহিত করতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থাৎ সকল ধর্মের মানুষের স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার তথা জাতীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং যুবসমাজের ন্যায্য অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১১ই নভেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মণি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্য থেকে স্বাধীনতা ও প্রগতিকামী যুবক ও যুব মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন গড়ে তোলাই ছিল যুবলীগের মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য।

শেখ মণিই প্রথম সম্মেলনের পরিবর্তে বার্ষিক সম্মেলনকে ‘কংগ্রেস’, দলের সভাপতি পদের পরিবর্তে চেয়ারম্যান এবং সহ-সভাপতি পদের পরিবর্তে প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ প্রবর্তন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী যুবলীগের প্রথম সম্মেলনে ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি যুবনেতা প্রিয় রঞ্জনদাস মুন্সী শেখ শেখ মণির
১৯৭৩ সালে বার্লিনে দশম বিশ্ব যুব সম্মেলনে
শেখ মণির প্রদত্ত ইংরেজি ভাষায় রাখা বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ দিবসে শেখ শেখ মণির বক্তব্যের প্রশংসা করেন জাতিসংঘ বাংলাদেশ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহম্মদ হোসেন।

আজকের এই মহান শিক্ষা দিবসে ৬২’ -এর দুর্বার ছাত্র-গণ আন্দোলনের সকল শহীদদের ও শিক্ষা আন্দোলনের নেপথ্যের নায়ক শহীদ শেখ ফজলুল হক মণির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: