odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯ ভাদ্র ১৪৩২
বিশেষ ফিচার

নীরবতার ছায়ায় মানবাধিকার: একটি অপ্রকাশিত বেদনা

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২০:২৫

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২০:২৫

✍️ বিশেষ ফিচার

প্রতি প্রভাতে পূর্বাকাশে সূর্য উদিত হয়। তাহার মৃদু কিরণ ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যায় এক ক্লান্ত রিকশাচালকের ধুলিমলিন পা, এক গৃহকর্মীর গুমোট নিঃশ্বাসে জমে থাকা অব্যক্ত আতঙ্ককে, কিংবা ফুটপথে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা পথশিশুর চোখে প্রতিফলিত এক অজানা, অপ্রত্যাশিত ভবিষ্যতের কল্পনাকে। কিন্তু সেই আলোর উষ্ণতায় কি সকলেরই সমান অধিকার আছে? নাকি তাহা কেবলমাত্র গুটিকয় মানুষের প্রাচীরবেষ্টিত জীবনের কপালেই বরাদ্দ? আলো আসে ঠিকই, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই আলো কি সকলের জন্য?

বাংলাদেশে মানবাধিকার আজ আর কেবল একটি ভাবধারা নহে—ইহা এক প্রাত্যহিক লঙ্ঘনের করুণ চিত্র। নগরের কংক্রিট বাঁধা রাস্তায় কিংবা গ্রামের কাদামাখা মেঠো পথে, গৃহস্থের উঠোন হইতে শুরু করিয়া নদীভাঙনের বালুময় কান্নায়—সর্বত্র ছড়াইয়া রহিয়াছে অধিকার হারানোর নিঃশব্দ ইতিহাস, যাহা অধিকাংশ সময়েই উচ্চারিত হয় না। গার্মেন্টসের পোড়া কারখানায় আটকা পড়া সেই শ্রমজীবী নারীর কান্না রাষ্ট্রের কর্ণগোচর হয় না। গ্রামীণ কৃষক, যাহার জমি ক্ষমতালোভীর হাতের শিকার, তাহার দুঃখ কেবল ‘সহনশীলতা’র খাতায় লিপিবদ্ধ হয়।

একজন নারী, যিনি নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা চাহিয়াছিলেন, তাহার প্রতি সমাজের নির্দয় প্রশ্ন—“মেয়ে হইয়া এমন কথা বলো?” তাহার স্বপ্নভরা চোখ দুটি সমাজের সভাগৃহে স্থান পায় না। আবার সেই দিনমজুর, যাহার পুত্রকে স্কুলের দরজায় ফিরাইয়া দেওয়া হয় এই বলে—“তোমার মতো গরিবদের ছেলেরা লেখাপড়া করিয়া কী হইবে?”—এই অবমাননা গোটা সমাজের সম্মানবোধকেই প্রশ্ন করে।

“মানবাধিকার” বলিতে আমরা বুঝি—জাতিসংঘের সনদ, আদালতের গম্ভীর বিতর্ক কিংবা এনজিওর রঙিন পোস্টার। অথচ যে রিকশাচালক সকাল হইতেই ঘামে শহর জাগাইয়া তোলে, যে হিজড়া প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা সয়ে বাঁচে, যে গৃহকর্মী একটি বাড়ি গুছাইতে গিয়ে নিজের সংসার গুছাইবার স্বপ্ন ভুলিয়া যায়—তাহারা কি জানেন, এই ‘মানবাধিকার’ শব্দের গভীরতা?

নারীরা প্রতিদিন পথে, ঘরে, কর্মস্থলে বঞ্চিত হন। কন্যাশিশু যখন নিজে বাল্যবিবাহ রুখিতে চায়, তখন সমাজ তাহাকে দোষী করে, কণ্ঠরোধ করে। গৃহকর্মী নারী এখনো নাগরিক নন, বরং যেন গৃহের অতিরিক্ত ছায়ামাত্র। এমনকি তাহার শ্রম, শ্রান্তি, সংবেদনশীলতাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।

প্রতিবন্ধী নাগরিকেরা প্রতিনিয়ত হীনদৃষ্টি ও অবহেলার শিকার। রাস্তা পার হওয়ার সুযোগ, বিদ্যালয়ে প্রবেশের অধিকার, চিকিৎসার মর্যাদা—কোনোটাই তাহাদের ভাগ্যে সহজে জোটে না। রাষ্ট্রের সংবিধানে নাম থাকিলেও বাস্তবতায় তাহারা যেন সমাজের বিস্মৃত সন্তান।

তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী, তাহাদের অস্তিত্ব যেন রাষ্ট্রের নথিপত্রে যতটা আছে, সমাজের চেতনায় ততটাই অনুপস্থিত। বাসা মেলে না, চাকরি মেলে না, সম্মান তো দূরের কথা, স্বীকৃতিই প্রশ্নবিদ্ধ। তাহাদের জীবন কেবল সামাজিক নিপীড়নের নয়, রাষ্ট্রীয় নীরবতার ইতিহাস।

শিশুদের অবস্থা আরেক করুণ অধ্যায়। যে বয়সে খেলাধুলা, গান, রঙ আর কবিতা থাকিবার কথা, সেই বয়সেই তাহারা থালা মাজে, ইট বহে, কিংবা দোকানের সামনে দাঁড়ায় হাত বাড়াইয়া। তাহাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় না “অধিকার” শব্দটি—কারণ তাহাদের শৈশব আগেই কেড়ে নেওয়া হইয়াছে।

প্রতিবছর দুর্যোগ আসে—বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, ভূমিধস। প্রতি বারের মতই হাজারো পরিবার নিঃস্ব হয়, গৃহহীন হয়, খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার মতো মৌলিক সেবাসমূহ থেকেও বঞ্চিত থাকে। ক্ষতিপূরণ শব্দটি যেন একটি বিলাসিতা মাত্র—ন্যায্যতা নয়, দয়া বলিয়াই বিবেচিত হয়।

আজ যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের করালগ্রাসে উপকূল অঞ্চল নিশ্চিহ্ন হইতেছে, বনভূমি উজাড় হইতেছে, নদীর বুক শুকাইয়া উঠিতেছে বালুর চরে, তখন কেবল প্রকৃতি নয়—মানুষের জীবন, নিরাপত্তা ও অধিকারও ভঙ্গুর হইয়া পড়িতেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এক একটি মানুষ তাহার ভূমি হারায়, অথচ রাষ্ট্রের রোজনামচায় তাহা শুধুমাত্র “পরিস্থিতি” বলিয়াই চিহ্নিত হয়।

রাজনীতির মহলে দুর্নীতি আজ এমন এক সংক্রমণ, যাহা রাষ্ট্রকে জনগণের চাহিদা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। ভোট কেনা যায়, সংবাদ স্তব্ধ করা যায়, প্রতিবাদ নিস্তব্ধ করা যায়—সবই সম্ভব হয় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে। এক দরিদ্র মানুষ বিচার চাহিলে তাহাকে বলা হয়, “এই মামলা বড়দের ব্যাপার।”

অবশেষে নীরবতা। রাষ্ট্রের, সমাজের, আমাদের সকলের—এই নীরবতা যেন এক সম্মিলিত অশ্রুত সম্মতি, যাহা মানবাধিকারের লঙ্ঘনকে নীরবে অনুমোদন দেয়।

এই পৃথিবীতে প্রতিদিন একটি বেদনার স্রোত প্রবাহিত হয়—অবিরাম, নিরবধি, গভীর। রাষ্ট্র ও সমাজ সেই স্রোতের শব্দ শুনিতে চায় না, কিংবা শুনিয়াও কিছু বলে না। কিন্তু আমরা জানি—এই স্রোত একদিন বাঁধ ভাঙিবেই।

আমরা প্রত্যাশা করি একটী এমন বাংলাদেশ, যেখানকার প্রতিটি নাগরিক—যাহা-ই তাহার পেশা, লিঙ্গ, ধর্ম, বয়স বা অবস্থান হউক না কেন—জানিবে, তাহার সম্মান আছে, অধিকার আছে, এবং তাহার জীবনের মূল্য অমূল্য।

আলো চাই, করুণা নহে—জন্মগত অধিকার বলিয়াই।

— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: