
-বিশেষ নিবন্ধ
মানুষ নাকি সমাজবদ্ধ প্রাণী। কিন্তু বাঙালিরা তার সঙ্গে যুক্ত করেছে নতুন এক বিশেষণ—দাওয়াতবদ্ধ প্রাণী। এই হাস্যকর, কূটনৈতিক, অলীক দাওয়াত সংস্কৃতিই আমাদের জীবনকে রঙিন রাখে। এক টুকরো কাগজ, এক ফোন কল, এক আমন্ত্রণ—ছোট মুহূর্তগুলোই আমাদের সামাজিক গল্পের ভিত্তি গড়ে তোলে। বাংলাদেশে বিবাহ করতে হলে অবশ্যই জানতে হবে দাওয়াতিবিদ্যা(Invitationology) এবং এই ছোট্ট দাওয়াতের গল্প আসলে সমাজবিজ্ঞানের নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে, যা নীচে বিশ্লেষণ করা হলো:
দাওয়াতের নামে সমাজতান্ত্রিক কমেডি!
"ভাই, আপনারে না দাওয়াত দিলে তো বিয়েই হবে না!"
—এই লাইনটা আজকাল শুধু ভালোবাসা নয়, এক প্রকার সামাজিক ইনস্যুরেন্স। আর তাই, এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়—বাঙালির বিবাহ দাওয়াত: উৎসব না প্রতিযোগিতা?
দাওয়াতপত্রে যতই থাকুক "আন্তরিক ভালোবাসা সহ", বাস্তবে কিন্তু দেখা যায় “কার গিফট ভারি, কার ইনস্টাগ্রাম স্টোরি বেশি ঝকমকে”—এই হিসেব।
বিয়ে মানেই এখন শুধুই প্রেম আর পাত্র-পাত্রীর মিলন নয়, বরং প্রদর্শনের এক অলিম্পিক।
ইতিহাস বলে: দাওয়াত ছিল সামাজিক ফরজ!
খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫০ সালের মেসোপটেমিয়া হোক বা মনুস্মৃতি, মহাভারত—বিয়েতে “সমাজ সাক্ষী থাকবে” এই ধারণা থেকেই দাওয়াত প্রথার জন্ম।
আর এখন?
"আমাদের মেয়ের বিয়ে, সবাই আসবেন"—ফেসবুকে ৩০০ লাইক, অথচ উপস্থিত ৭।
রসূল (সা.) বলেছিলেন, “সেই ওয়ালিমা নিকৃষ্ট যেখানে শুধু ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়।”
বাস্তবে, এখন গরীব আত্মীয়দের নামটাই আসে না তালিকায়। তারাও জানে—"ফেসবুকে আশীর্বাদই তাদের কপাল"।
Invitationology: দাওয়াতের সমাজতাত্ত্বিক শ্রেণীবিন্যাস!
এখন সময় এসেছে নতুন এক তত্ত্বের—Invitationology।
কারণ, বাঙালির বিবাহের দাওয়াত মানে কেবল আহ্বান নয়, বরং এক ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সিগন্যালিং সিস্টেম।
এখানে এক টুকরো কার্ড মানে—সম্মান, প্রেস্টিজ, সামাজিক অবস্থান।
দাওয়াতের নয়টি শ্রেণি:
- ভিআইপি দাওয়াত: "আপনি না এলে আমাদের মন ভরবে না"—মানে, ফটোগ্রাফারকে আপনার স্যুট দেখাতে হবে।
- কার্ডি দাওয়াত: ছাপানো ভালোবাসা + মোবাইল নম্বর = RSVP কেউ পড়ে না।
- ফোন দাওয়াত: বাজেট কম? ফোনে কনভিন্স: “আপনারে তো মুখেই বলা হইছে, ভাই!”
- ড্রাইভার দাওয়াত: "বাবু দিছেন"—কে বাবু, কোথায় বিয়ে, কেউ জানে না।
- ই-দাওয়াত: ফেসবুক ইনভাইট, ইমেইল কার্ড, ইনবক্স “আসবেন তো?”—প্রেম নেই, শুধু লিংক।
- লোক দেখানো দাওয়াত: “যেন মনে না করে”—আসলে, যেন না আসে।
- দাওয়াত দেওয়ার জন্য দাওয়াত: দেখনদারি ইনভাইট, যাওয়া না যাওয়ার গুরুত্ব নাই।
- গণ-দাওয়াত: মাইকিং করে পুরো এলাকাবাসীকে দাওয়াত—“সবাই আসবেন”। কে "সবাই"? কেউ জানে না।
- অন্যান্য : এছাড়াও আরো অনেক প্রচলিত ও অপ্রচলিত রীতি আছে।
সামাজিক কূটনীতি: দাওয়াত না পেলেই ক্ষত-বিক্ষত সম্পর্ক!
“কে কাকে দাওয়াত দিল না”—এই বাক্য দিয়েই জন্ম হয় সোশ্যাল পলিটিক্স।
ফুফু পেলেন শুধু বৌভাতের দাওয়াত, গায়ে হলুদের ইনভাইট গেল মামার দিকে।
অফিস কলিগরা বলছে—"কার্ড পাইছি, কিন্তু তার পাশের ডেস্কে বসা রাজুকে দেয় নাই!" - এটা দাওয়াত নয়, এটি ক্ষমতা প্রদর্শনের কূটচাল।
দাওয়াত মানে লোকদেখানো কৌশল: দাওয়াত=সম্মান?
একজন ডাকেন ৫০০ জন, যেন সমাজ বলে—“কি বিশাল আয়োজন!”
আর অন্যজন আমন্ত্রণ না পেয়ে পরের বিয়েতে বাদ দিয়ে “রিভেঞ্জ ইনভাইট” দেন।
এভাবেই চলে "বাঙালি দাওয়াত সংস্কৃতির রিয়েলিটি শো"।
শেষ কথা: দাওয়াত মানে সম্পর্কের আয়না
এক টুকরো আমন্ত্রণপত্র মানে অনেক কিছু—স্মৃতি, মান-অভিমান, শ্রদ্ধা আর স্বীকৃতি।
বিয়ে একদিনেই শেষ হয়, কিন্তু “ওই বিয়েতে আমাকে ডাকে নাই” এই কথাটা থাকে গেঁথে প্রজন্ম ধরে। তবু, এই রঙ্গিন, কুটিল, মজার দাওয়াত সংস্কৃতিই আমাদের বাঙালিয়ানা—একটা সামাজিক কমেডির বেস্টসেলার অধ্যায়।
— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com
আপনার মতামত দিন:
আপনার মতে, বাঙালির বিবাহ দাওয়াত এখন কি কেবল প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা হয়ে গেছে?
Comment করুন: Agree / Disagree / It’s complicated!
#বাঙালি_বিয়ে #বাংলাদেশি_বিবাহ #দাওয়াত_সংস্কৃতি # #সামাজিক_কূটনীতি #বাঙালির_বিয়ে #ফেসবুক_দাওয়াত #বিয়ের_দাওয়াত #বাংলা_ফিচার #হাস্যরসাত্মক_আর্টিকেল #BanglaWedding #BanglaFeature #দাওয়াত_রাজনীতি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: