odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Sunday, 7th December 2025, ৭th December ২০২৫
লির পৃথিবীতে ন্যায়ের দীপ্তি। অস্থির পৃথিবীতে মানবজীবনের অন্তর্গত উদ্দেশ্য—সত্য, ন্যায় ও স্রষ্টার পথে আত্মার দীর্ঘ যাত্রা।

জীবনের সমাচার: অস্থির পৃথিবীতে ন্যায়, সত্য ও ঈমানের পথযাত্রা

odhikarpatra | প্রকাশিত: ১৬ October ২০২৫ ২২:৪৮

odhikarpatra
প্রকাশিত: ১৬ October ২০২৫ ২২:৪৮

— উপসম্পাদকীয়

মানবজীবন এক অনির্বচনীয় রহস্য। ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যপরায়ণ মানুষ আজ অধিক যাতনা ভোগ করিতেছে; মনে হয়, মহান সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁদের আনুগত্য, ধৈর্য ও নৈতিক স্থিতির পরীক্ষা গ্রহণ করিতেছেন। আসলে এই জগত এক রঙ্গমঞ্চ—যেখানে কল্যাণ ও অকল্যাণ, আলো ও অন্ধকার, সত্য ও মিথ্যা পাশাপাশি অভিনয় করিতেছে।

বিকেলের ম্লান আলোয় এক বৃদ্ধ বসিয়া আছেন নদীর তীরে। দূরে সূর্য অস্তাচলে, আকাশের রঙ লাল ও সোনার আভায় মিশিয়া গেছে। সেই বৃদ্ধের চোখে জলের প্রতিফলন যেন অন্য এক জগতের স্মৃতি বহন করিতেছে—যে জগতে মানুষ ছিল সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, আর হৃদয় ছিল স্রষ্টার প্রেমে ভরা। তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, “আজ ন্যায়ের মানুষরা কষ্ট পায় বেশি। মনে হয়, মহান সৃষ্টিকর্তা যেন তাহাদের আনুগত্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন।”

এই কথার মধ্যে লুকায়িত রহিয়াছে জীবনের চিরন্তন দার্শনিক প্রশ্ন—জীবন কাহাকে বলে, কেন আমরা এই ধূলির পৃথিবীতে আগমন করিলাম, এবং কোন পথে গেলে এই অস্থিরতার মাঝে শান্তি মিলিবে? পৃথিবী এক অদ্ভুত মঞ্চ—যেখানে ন্যায় ও অন্যায় পাশাপাশি অভিনয় করে, আলো ও অন্ধকার হাত ধরিয়া চলে। কেহ ন্যায়ের প্রদীপ জ্বালায়, আবার কেহ অন্যের অশ্রু দিয়াই নিজের হাসি সাজায়। তবু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মিথ্যার অট্টহাসি যত উচ্চরবেই হউক না কেন, সত্যের ধ্বনি শেষপর্যন্ত আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়।

আল-কোরআনের মহা-আয়াত আমাদের সেই সত্যই স্মরণ করায়— “তোমরাই সর্বোত্তম উম্মাত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হইয়াছে; তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজ হতে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখো।” (আলে-ইমরান: ১১০) -এই আয়াত মানবজীবনের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করিয়া দেয়—মানুষ স্রষ্টার প্রতিনিধি, যাহার জীবন হইবে কল্যাণের জন্য, ন্যায়ের পথে, ঈমানের আলোকে। যদি মানুষ এই দায়িত্ব বিস্মৃত হয়, তবে তাহার জীবন হইবে দিকহীন নৌকার ন্যায়—চঞ্চল, কিন্তু উদ্দেশ্যহীন। আসলেই এই আয়াত হচ্ছে এমন এক অনন্ত আহ্বান, যা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়—মানুষের অস্তিত্ব কেবল মাটির নয়, তাহার ভিতরে আছে ঐশী দায়িত্বের দীপ্তি। আমরা পৃথিবীতে আগমন করিয়াছি কল্যাণের জন্য, দয়া ও ন্যায়ের বার্তাবাহক হইয়া। কিন্তু কত সহজেই সেই উদ্দেশ্য বিস্মৃত হই!

সক্রেটিস একদিন বলিয়াছিলেন— The unexamined life is not worth living অর্থাৎ যে জীবন আত্মঅন্বেষণহীন, তা কেবল একটি দেহের যান্ত্রিক চলন, কোনো গভীর তাৎপর্য নেই তাতে। দিশাহীন নদীর মতো, যাহার স্রোত আছে—কিন্তু গন্তব্য নাই। ইবনে সিনা বলিয়াছিলেন, “মানব আত্মা স্রষ্টার নিকট আরোহনের জন্যই সৃষ্টি।” সেই সত্য আজও ততধিক প্রযোজ্য। আত্মবিচারহীন জীবন কেবল প্রবাহিত হইয়া যায়, কিন্তু এই আরোহনই জীবনের প্রকৃত গতি—অসারতার পরিত্যাগ, আর পরম সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়া। প্রেম ও আত্মার কবি রুমি যেন সেই চিরন্তন ধ্বনি উচ্চারণ করেন:

তুমি মৃত নও, তুমি এক চলমান আত্মা;

মৃত্যুর পরও তোমার যাত্রা থামে না।

রুমির মতে, “ক্ষতই তো স্থান, যাহা দিয়া আলোর প্রবেশ ঘটে।” মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাই অভিশাপ নহে; ইহাই পরিশুদ্ধির পথ। আল্লাহ বলেন—“আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করিব ভয়, ক্ষুধা ও সম্পদের ক্ষতি দ্বারা; কিন্তু ধৈর্যশীলদের জন্য রহিয়াছে সুসংবাদ।” (সূরা বাকারা: ১৫৫) -জীবন এই পরীক্ষারই নাম। কেহ হাসিতে উত্তীর্ণ হয়, কেহ অশ্রুতে। কিন্তু যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে, সে সত্যের নিকটবর্তী হয়। এই ভাবনাগুলি ইসলামী আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সমহারে মিশে আছে। আল্লাহ বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমান আনে সৎকাজ করে, আমি তাহাকে এমন জীবন দান করিব, যাহা পবিত্র পরিতৃপ্ত। (সূরা নাহল: ৯৭)। জীবন, তাই, নিছক দেহের অস্তিত্ব নয়; এটি এক আত্মিক জাগরণ, যেখানে আত্মা ধীরে ধীরে শুদ্ধ হয়, ন্যায়ের পথে পদচিহ্ন ফেলে এবং এক অনন্ত নিকটতায় পৌঁছাতে চায়—তার স্রষ্টার দিকে। এই

বৃদ্ধটি তখন আকাশের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “শান্তি খুঁজিলে মানুষকে ফিরিতে হইবে আল্লাহর ঘরে। তাহার নাম উচ্চারণেই অস্থিরতা প্রশমিত হয়।” সত্যই তো—প্রিয় হাবীব (সা.)–এর রওজা জিয়ারতের যে প্রশান্তি, তাহা কেবল অনুভবে ধরা পড়ে, কথায় নয়। সেই শান্তি আত্মাকে স্থির করে, মনকে স্থিত করে, জীবনকে অর্থ দেয়।

এই পৃথিবীতে শান্তি ও অশান্তি পাশাপাশি চলিতেছে। কেহ নির্মমতার হাসি হাসে, অন্যের বেদনা লইয়া আনন্দ পায়। অর্থ্যাৎ এক শ্রেণির মানুষ শান্তি স্থাপনে প্রয়াসী, অন্যেরা অশান্তি সৃষ্টি করিয়া অপরের কষ্টে হাসে। কিন্তু তাহারা ভুলিয়া যায়—“নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যাচারীদের পছন্দ করেন না।” (আলে-ইমরান: ৫৭) ।  -আসলেই দুইদিনের এই ধরণীতে যে অন্যায়ে হাসে, সে আসলে নিজের আত্মাকে কাঁদায়; যে অন্যের দুঃখে সহানুভূত হয়, সে স্রষ্টার নিকট আপন হয়। অপরদিকে অন্যের দুর্ভোগে হাস্যোন্মত্ত হওয়া, ক্ষমতার মোহে অন্যায়ে লিপ্ত থাকা—ইহাই পতনের পূর্বাভাস। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যে জাতি ন্যায় ত্যাগ করে, সে জাতি অবশেষে বিলুপ্ত হয়।

বাঁচিয়া থাকা নহে, বরং স্রষ্টার উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণ। ইমাম গাজ্জালী লিখিয়াছেন—“যে ব্যক্তি আত্মাকে চিনিল, সে তাহার প্রভুকে চিনিল।” অর্থাৎ আত্মচেতনার মধ্য দিয়াই স্রষ্টাচেতনা জন্মে। মানুষ যখন আল্লাহর ঘরে—তাঁহার আনুগত্যে, তাঁর স্মরণে, তাঁর দয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে—তখন জীবনের নব অর্থ উদ্ভাসিত হয়। প্রিয় নবী (সা.)-এর রওজা জিয়ারতের যে শান্তি, তাহা কেবল ভক্ত হৃদয়ই অনুভব করে। এই শান্তিই আত্মাকে স্থিতি দেয়, আর স্থিতি দিয়াই মানুষ সত্যিকার জীবনের অর্থ উপলব্ধি করে।

শেষ আলোটি নিভিয়া এলে বৃদ্ধটি মৃদুস্বরে বলিলেন, “জীবন মানে কেবল বাঁচিয়া থাকা নয়। জীবন মানে—স্রষ্টার দিগন্তে যাত্রা।” এবং তখন মনে হয়, যেন নদীর ঢেউ, আকাশের আভা ও মানুষের নিঃশ্বাস—সব মিলিয়া এক স্বরেই উচ্চারণ করিতেছে: “যে ন্যায়ের পথে চলে, সে-ই সত্যিকার জীবিত।”

এই বৃদ্ধের জীবনের সমাচার শেষতঃ আমাদিগকে এই শিক্ষা প্রদান করে—ন্যায়পরায়ণতাই মানবের শ্রেষ্ঠ গৌরব। বেঁচে থাকাই লক্ষ্য নহে; ন্যায়, সত্য ও করুণার পথে বাঁচাই পরম সফলতা। পৃথিবী এক অস্থায়ী মঞ্চ, যেখানে আল্লাহর খলিফা হিসেবে মানুষ অভিনয় করিতেছে; কিন্তু যাহারা স্রষ্টার বিধান অনুসারে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করিবে, তাহারাই ইতিহাসে অনন্ত আলো হয়ে রহিবে।

✍️ অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#ইসলামওজীবনেরঅর্থ #সর্বোত্তমউম্মাহ  #আলকোরআনেরদিকনির্দেশ  #আধ্যাত্মিকশান্তি  


আপনার মূল্যবান মতামত দিন: