আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতের ভেতরে গোপনে পরিচালিত হচ্ছে এক অনন্য নভোচারী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত এই Sasso San Gottardo নামের দুর্গে এখন চলছে ‘Asclepios’ নামে এক স্টুডেন্টডের মহাকাশ মিশন। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ তরুণীরা অংশ নিচ্ছেন বাস্তবধর্মী চাঁদ মিশনের অনুকরণে। দুর্গটি ২,০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং ভেতরে রয়েছে প্রায় ৩.৫ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গপথ। সারা বছর এখানে তাপমাত্রা থাকে মাত্র ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একসময় এখানে স্থাপিত কামানগুলো ২৬ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারত। আজ সেই অন্ধকার, ঠান্ডা ও সঙ্কীর্ণ সুড়ঙ্গগুলোই পরিণত হয়েছে চাঁদের গুহার অনুকরণে গঠিত প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে। Asclepios প্রকল্পে অংশ নিচ্ছেন প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী, যারা ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ESA) ও নাসার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অনুকরণে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এখানে অংশগ্রহণ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, অর্থায়ন আসে দান ও ক্রাউডফান্ডিং থেকে। অংশগ্রহণকারীরা বাস্তব মহাকাশ অভিযানের মতোই কঠোর পরিবেশে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ পান। বরফ ঢাকা পাহাড়ে রাত কাটানো, হিমজলে ডুব দেওয়া, জিরো গ্র্যাভিটি ফ্লাইটে অংশ নেওয়া এবং স্পেস সাইকোলজির পাঠ গ্রহণ। ব্রাজিলের একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী এই মিশনের কমান্ডার হিসেবে পুরো চাঁদ ঘাঁটির দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, অন্য মহাকাশ সিমুলেশনগুলো সাধারণত অর্থের বিনিময়ে হয়। কিন্তু Asclepios শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ও বিনামূল্যে। মিশনের সময় ৯ সদস্যের এই দল ১৬ দিন কাটান ভূগর্ভস্থ চাঁদ ঘাঁটিতে। বাস্তব নভোচারীর মতোই ডিহাইড্রেটেড খাবার খেয়ে, সীমিত পানি ও আলো ছাড়া কাজ করে। তারা রাতের আঁধারে পর্বতের সুড়ঙ্গে “চাঁদে হাঁটা”র অনুশীলন করেন।
এই বছর পুরো মিশনটি পরিচালিত হচ্ছে অন্ধকার পরিবেশে যাতে আলো না থাকার প্রভাব মানব দেহ ও মস্তিষ্কে কেমন পড়ে তা বিশ্লেষণ করা যায়। বিজ্ঞানীরা অংশগ্রহণকারীদের ঘুম, দেহের তাপমাত্রা ও মেলাটোনিন হরমোন পর্যবেক্ষণ করছেন। যাকে বলা হচ্ছে Kronoespazio Project। যুক্তরাজ্যের ম্যাথিউ অ্যাসেভস্কি, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের পিএইচডি গবেষক এই মিশনে সায়েন্স অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। আমি এখন মানব মহাকাশ গবেষণায় আরও যুক্ত হতে চাই। আরেক সদস্য লরেন পলসন মার্কিন ও ব্রিটিশ দ্বৈত নাগরিক এই মিশনে বেস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, যেভাবে মহাকাশে পানি, বর্জ্য বা শক্তি অপচয় করা যায় না, সেভাবে পৃথিবীতেও আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত। মহাকাশ প্রযুক্তি থেকেই টেকসই জীবনের ধারণা শেখা সম্ভব। এই তরুণ তরুণীরা যখন তাদের “চাঁদের ঘাঁটিতে” ব্যস্ত তখন বাইরে আল্পসের শীতল বাতাসে ভেসে বেড়ায় একটাই প্রশ্ন একদিন কি তারা সত্যিই আমাদের গ্রহ ছাড়িয়ে অন্য কোনো জগতে পদার্পণ করবে? সুইজারল্যান্ডের পর্বতের গভীরে পরিচালিত এই অনন্য প্রকল্পটি শুধু মহাকাশ অনুশীলনের ক্ষেত্র নয় বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও নভোচারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। যুদ্ধের জন্য নির্মিত দুর্গ আজ শান্তিপূর্ণ গবেষণা ও মানব উন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠেছে। চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহে মানব বসতি গড়ার স্বপ্ন যতই দূরের মনে হোক না কেন সেই স্বপ্ন বাস্তবের আরও কাছাকাছি আনছে এমন উদ্যোগই সুইস পর্বতের এই গোপন নভোচারী স্কুল।
-মো: সাইদুর রহমান (বাবু), বিশেষ প্রতিনিধি. অধিকারপত্র

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: