odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Sunday, 28th December 2025, ২৮th December ২০২৫
বিসিএস-এর গোলকধাঁধা থেকে মুক্তির উপায়: প্রচলিত শিক্ষা বনাম স্কিল গ্যাপের বাস্তব চিত্র ও আমাদের করণীয়।

‘পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছ?’: বিসিএস-এর গোলকধাঁধা ও বেকারত্বের মরীচিকা

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ২৮ December ২০২৫ ০৯:৩২

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ২৮ December ২০২৫ ০৯:৩২

সম্পাদকীয় বিশেষ কলাম (Editorial Feature Column) | তৃতীয় পর্ব

নীলক্ষেতের গলি থেকে বিসিএস-এর টেবিল—শিক্ষিত বেকাররা কি আসলেই পথ হারিয়েছে? বঙ্কিম ও নজরুলের দর্শনে আজকের চাকরির বাজার, স্কিল গ্যাপ এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে এক গভীর রম্য বিশ্লেষণ।

বিশেষ দৃষ্টি: একজন পথভোলা পর্যবেক্ষক

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রোমান্টিক অথচ ট্র্যাজিক দৃশ্যগুলোর একটি—বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের সেই ঘন অরণ্য, সমুদ্রের গর্জন আর নবকুমারের পথ হারানোর মুহূর্ত। নবকুমার যখন পথ হারিয়েছিলেন, তখন তাঁর সামনে ছিল ভয়ংকর সুন্দর সমুদ্র আর এক রহস্যময়ী নারী, যিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?”

কিন্তু হায়! দেড় শ বছর পর আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি নবকুমার জন্মাতেন, তবে তিনি কোনো নির্জন সৈকতে পথ হারাতেন না। তিনি পথ হারাতেন নীলক্ষেতের গাইড বইয়ের স্তূপে, শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরির লম্বা লাইনে, অথবা মতিঝিলের অফিসপাড়ার জ্যামে। আজকের নবকুমারদের হাতে কোনো হারিকেন থাকে না, থাকে একতাড়া বায়োডাটা আর চোখেমুখে থাকে একরাশ হতাশা। বঙ্কিম ও নজরুলের সেই চিরন্তন প্রশ্নটিকে যদি আমরা আজকের চাকরির বাজার ও বেকারত্বের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করি, তবে এক করুণ অথচ হাস্যকর চিত্র ফুটে ওঠে। এ যেন এক আধুনিক ট্র্যাজেডি, যেখানে ভিলেন কোনো কপালকুণ্ডলা বা কাপালিক নয়, ভিলেন হলো আমাদের ‘সিস্টেম’ এবং ‘স্কিল গ্যাপ’।

আরো পড়ুন অধিকারপত্র ধারাবাহিক সম্পাদকীয় বিশেষ কলাম (Odhikarpatra Editorial Feature Column Series) - দ্বিতীয় পর্ব / 'পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো?' — শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম ও জিপিএ-৫ এর গোলকধাঁধায় বঙ্কিম ও নজরুল

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিসিএস জ্বর’: ঝুঁকিহীন জীবনের খোঁজে তারুণ্য

আমাদের সমাজে সাম্প্রতিক সময়ে বিসিএস চাকরি যেন ‘নিশ্চিত জীবনের আফিম’-এ পরিণত হয়েছে। এটি এখন আর কেবল একটি চাকরি নয়, বরং তারুণ্যের কাছে এক ‘সোনার হরিণ’। অদ্ভুত এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি—এমবিবিএস পাস করে ডাক্তারি পেশায় না গিয়ে এই প্রজন্মের মেধাবীরা ঝুঁকছে বিসিএস প্রশাসন বা পুলিশের চাকরিতে। কিন্তু এর পেছনের কারণ কী? তারুণ্য কেন ঝুঁকি নিতে ভয় পায়? কেন মেধাবীদের গন্তব্য শুধুই বিসিএস?

নেপথ্যে মূলত সেই ‘নিশ্চিত জীবন’-এর হাতছানি। ঝুঁকিহীন জীবনের খোঁজে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার এই অসম প্রতিযোগিতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করে। তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে—এই বিসিএস-প্রীতি কি আসলে স্বপ্নের নাম, নাকি গভীর কোনো সংকটের প্রতীক?

সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরল নজির। তবে এই নজিরবিহীন ঘটনার মূলে রয়েছে এ দেশের তরুণদের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা। স্বপ্নপূরণের পথ কণ্টকমুক্ত করতেই মূলত কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে যেখানে তরুণদের হওয়ার কথা একেকজন উদ্যোক্তা, সেখানে সরকারি চাকরির মোহে সবাই হন্যে হয়ে ছুটছে বিসিএস-এর পেছনে। আমাদের মনস্তত্ত্বে এই ধারণা গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে—একবার বিসিএস জুটলেই জীবন সুনিশ্চিত। কিন্তু কেন এই মানসিকতা? এর মূলে রয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত ব্যর্থতা ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অক্ষমতা। এই ব্যর্থতা তরুণদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাচ্ছে, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস কেড়ে নিচ্ছে এবং ঠেলে দিচ্ছে তথাকথিত ‘নিশ্চিত জীবন’-এর দিকে। আর এই প্রবণতাই দেশে উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে জন্ম দিচ্ছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার।

এই বাস্তবতার শিকড় অত্যন্ত গভীর। দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও শিক্ষা নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা তৈরি করেছে এক আজব পরিস্থিতির। এমন এক পরিস্থিতি যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাটিকেই ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এই ডিজিটাল এই যুগে আমাদেরকে যেনো মগজটাকে তুলে রাখতে হয়েছে ‘ফ্রিজে’, অপরদিকে সকল হতাশার থেকে মুক্তির মহৌষধ হিসেবে হাতে েউঠে এসছে স্মার্টফোন। আর এর মাধ্যমে এখন ভার্চুয়াল জগতে এক ক্লিকেই আমরা দেশ উদ্ধার করছি, অথচ বাস্তবে কোনো গঠনমূলক ভূমিকা রাখছি না। হায় রে আমাদের ‘হুজুগে’ মানসিকতা! সব চিন্তার দৌড় যেন ওই বিসিএস পর্যন্তই।

আরো পড়ুন (প্রথম পর্ব) — বাংলা সাহিত্য, সামাজিক বাস্তবতা ও ডিজিটাল জীবনের গোলকধাঁধায় পথ হারানো বাংলাদেশের এক রম্য-সমালোচনামূলক পাঠ | ‘পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো?’ নজরুলের দুর্দিনের যাত্রী, নবকুমারের কপালকুণ্ডলা এবং আজকের ডিজিটাল গোলকধাঁধা

ঢাবি লাইব্রেরি: নজরুলের আশা বনাম বঙ্কিমের সাবধানবাণী

দৃশ্যপট: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার | সময়: সকাল ৭টা।

গেট খুলতে এখনো ঘণ্টাখানিক বাকি। তাতে কি! লাইব্রেরিতে প্রবেশ করার জন্য গেট থেকে লাইন সাপের মতো এঁকেবেঁকে প্রায় এক কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। পাশেই কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আধ্যাত্মিক জগত থেকে এই দৃশ্য দেখে কবি হয়তো খুবই আশাবাদী হয়ে উঠতেন। তিনি হয়তো ভাবতেন, “আহা! আমার সোনার দেশের ছেলেরা বিদ্যার জন্য কতই না লালায়িত! ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা জ্ঞানের মন্দিরে ধড়না দিচ্ছে।”

কিন্তু পাশ থেকে বঙ্কিমচন্দ্র হয়তো মুচকি হেসে কবিকে সতর্ক করতেন। তিনি বলতেন, কাজী দা, থামুন। আবেগে ভাসিবেন না। ইহারা বিদ্যার প্রতি টানে এই লাইনে দাঁড়ায় নাই। ইহারা দাঁড়াইয়াছে যাতে লাইব্রেরির এসির বাতাসে বসিয়া নিরিবিলিবিসিএস গাইডমুখস্থ করার একটিসিটপাওয়া যায়। ইহাদের লক্ষ্য জ্ঞানার্জন নহে, ইহাদের লক্ষ্য গ্যাজেটেড অফিসার হওয়া।

আসলেই তাই। পরিস্থিতি এতটাই করুণ যে, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (IER) এক অধ্যাপক সেদিন ক্লাসে রসিকতা করে (নাকি ক্ষোভে?) বললেন, আমাদের উচিত এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব একাডেমিক বিভাগ বন্ধ করে দিয়ে একটাই ডিপার্টমেন্ট খোলা—‘ডিপার্টমেন্ট অব বিসিএস প্রিপারেশন’।” এখানে সবাই ‘মায়ের পূজার বলি’ হতে প্রস্তুত। কারণ, আমাদের সামাজিক কাঠামো শিখিয়েছে—ক্যাডার হওয়া ছাড়া এ সমাজে সম্মান পাওয়ার আর কোনো ‘অগ্নিরথ’ নেই।

বিসিএস-এর ‘কাপালিক’ ও নীলক্ষেতের পিলগ্রিমেজ

কাজী নজরুল ইসলামের ‘রুদ্র-মঙ্গল’ প্রবন্ধের সেই ভয়ঙ্কর ‘কাপালিক’-এর বর্ণনা মনে আছে? যার রক্ত-তিলক পরা মন্দিরে নরবলির জন্য সব প্রস্তুত। আজকের দিনে সেই মন্দিরের নাম বদলে হয়েছে ‘বিসিএস (BCS)’। আর আমাদের লক্ষ লক্ষ গ্র্যাজুয়েট আজ নজরুলের সেই ‘ভৈরবী-সূতা’র মতো বিসিএস-এর পেছনে ছুটছে। তাদের কপালে রক্ত-তিলক নেই বটে, তবে রাত জাগার কারণে চোখের নিচে আছে গভীর কালচে দাগ, যাকে আধুনিক ‘স্ট্রেস-তিলক’ বলা যেতে পারে।

বঙ্কিমচন্দ্র যদি আজ নীলক্ষেতের মোড়ে হাঁটতে যেতেন, তবে দেখতেন হাজার হাজার নবকুমার আর নবকুমারী জীর্ণ শীর্ণ বেশে ডাইজেস্ট আর গাইড বইয়ের পাহাড় নিয়ে বসে আছে। তিনি হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, পথিক, তোমরা তো জ্ঞানের অবারিত পথ হারাইয়া বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি সিলেবাসের অরণ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছ!”

এখানে সবাই ‘মায়ের পূজার বলি’ হতে প্রস্তুত। কারণ, আমাদের সামাজিক কাঠামো শিখিয়েছে—ক্যাডার হওয়া ছাড়া এ সমাজে সম্মান পাওয়ার আর কোনো ‘অগ্নিরথ’ নেই। যৌবনের সোনালি সময়, সৃজনশীলতা, আর প্রেমের কবিতাকে ‘স্যাক্রিফাইস’ করে এরা লাইব্রেরির টেবিলে মাথা ঠুকে মরছে। লক্ষ্য একটাই—গেজেটেড কর্মকর্তার সিলমোহর। এ এক অদ্ভুত পিলগ্রিমেজ বা তীর্থযাত্রা, যেখানে দেবতার দেখা পায় মুষ্টিমেয় কয়েকজন, আর বাকিরা প্রসাদ হিসেবে পায় হতাশা আর ‘বয়স শেষ’ হওয়ার সার্টিফিকেট।

আরো পড়ুন: দুই মিনিটে সব পাওয়ার নেশায় আমরা কোন অন্ধগলিতে হারিয়ে যাচ্ছি? শর্টকাট সংস্কৃতি, নৈতিক স্খলন ও আত্মমোহের রম্য পর্যালোচনা। শর্টকাট গন্তব্য: আমরা আসলে যাচ্ছিটা কই?

চাকরির ইন্টারভিউ: নজরুলের ‘সিংহ-শার্দূল’ ও বাস্তবতার জঙ্গল

নজরুল বলেছিলেন, সিংহ-শার্দূল-শঙ্কিত কণ্টক-কুণ্ঠিত বিপথে আমাদের চলা।” একজন বেকারের জন্য একটি প্রাইভেট বা সরকারি চাকরির ইন্টারভিউ ঠিক তেমনই এক অভিজ্ঞতার নাম। সেজেগুজে, টাই-কোট পরে, বগলে ফাইল চেপে যখন সে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে দাঁড়ায়, তখন তার অবস্থা হয় বঙ্কিমের সেই পথহারা পথিকের মতো।

বোর্ড মেম্বাররা আধুনিক যুগের কাপালিক। তাঁরা হিংস্র চোখে তাকান এবং এমন সব প্রশ্ন করেন, যার সাথে প্রার্থীর পঠিত বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। “আচ্ছা বলুন তো, মশা কত ফুট উচ্চতায় উড়তে পারে?” কিংবা “চাঁদের বুড়ির সুতা কাটার স্পিড কত?”

প্রার্থী তোতলায়, ঘামে। কিন্তু আসল প্রশ্নটা সেখানে হয় না। আজকের যুগের “পথ হারাইয়াছ?” প্রশ্নটির আধুনিক ও অলিখিত সংস্করণ হলো— “আপনার মামু বা খালু কে?”

যার মামু নেই, মন্ত্রী বা আমলা আত্মীয় নেই, সে আসলেই এই চাকরির বাজারে পথ হারিয়েছে। নজরুল যে ‘ভৈরব-গান’ গেয়েছিলেন, তা আজ কর্পোরেট জগতের ‘টার্গেট পূরণ’, ‘চাটুকারিতা’ আর ‘ওভারটাইম’-এর চিৎকারে চাপা পড়ে গেছে। মেধার চেয়ে যেখানে ‘রেফারেন্স’ বড় হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে পথ চিনে নেওয়াটা গুগল ম্যাপের সাধ্যেরও বাইরে।

বেকারত্বের ‘তাতা থৈথৈ’ ও স্কিল গ্যাপের গহ্বর

নজরুলের প্রবন্ধে এক তান্ডব নৃত্যের বর্ণনা ছিল— তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ। আমাদের চাকরির বাজারেও আজ এক অদ্ভুত নাচ চলছে। একদিকে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার রাস্তায় ঘুরছে, অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রি বা মালিকপক্ষ চিৎকার করছে—তারা ‘যোগ্য লোক’ খুঁজে পাচ্ছে না। এই যে মাঝখানের বিশাল গ্যাপ, এটাই হলো আমাদের বর্তমানের ‘গহন বন’।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন একেকটা ‘ইতিহাস তৈরির কারখানা’। শিক্ষার্থীরা বের হচ্ছে নজরুলের ‘অগ্নিরথ’ চড়ার স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে গিয়ে দেখছে তারা আসলে ‘অ্যানালগ নবকুমার’। তাদের শেখানো হয়েছে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ কবে হয়েছিল, কিন্তু শেখানো হয়নি কীভাবে পাইথন দিয়ে কোড লিখতে হয় কিংবা কীভাবে ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করতে হয়।

তারা সি-প্লাস প্লাস, এআই (AI) বা গ্রাফিক ডিজাইনের আধুনিক বনের পথ চেনে না, চেনে কেবল মুখস্থ করা কিছু পুরনো বুলি। ফলে বাজারে তাদের দাম নেই। তারা হতাশ হয়ে নজরুলের সেই রক্ত-ভুখারিনির তৃষ্ণাবিহ্বল জিহ্বা-র মতো দারিদ্র্যের মুখে পতিত হয়। সার্টিফিকেট আছে, কিন্তু স্কিল নেই—এ যেন পকেটে টাকা আছে, কিন্তু দোকানে কোনো পণ্য নেই। 

[Enjoy the 🎬 প্রোমো - অধিকারপত্র সম্পাদকীয় সিরিজ — পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো?| বাংলা সাহিত্য × ডিজিটাল বাস্তবতা, Click on the Video link https://www.youtube.com/shorts/5A75azsMUIk]

পরিসংখ্যানের আয়নায় নবকুমারের মুখ (BBS 2024)

বঙ্কিমবাবুর নবকুমার বনপথে হারিয়েছিলেন দিকভ্রান্ত হয়ে, কিন্তু আজকের গ্র্যাজুয়েটরা পথ হারাচ্ছে তাদের অর্জিত ‘ডিগ্রি’ আর বাজারের ‘ডিমান্ড’-এর মধ্যে থাকা হিমালয় সমান দূরত্বের কারণে। আবেগের কথা বাদ দিয়ে এবার একটু কঠিন পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) লেবার ফোর্স সার্ভে ২০২৪-এর ফাইনাল রিপোর্ট আমাদের সামনে যে আয়না ধরেছে, তাতে নবকুমারের মুখটা বড়ই মলিন। এখানে ফুটে ওঠেছে কতগুলো রূঢ় বাস্তবতা:

  • বেকার স্নাতকের সংখ্যা: দেশে বর্তমানে প্রায় .৮৫ লক্ষ (প্রায় লক্ষ) উচ্চশিক্ষিত বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
  • বেকারত্বের হার: স্নাতক বা তার চেয়ে বেশি ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩.%, যা গত বছরের (১৩.১১%) তুলনায় বেড়েছে। অর্থাৎ, যত বেশি পড়াশোনা, তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি!
  • যুব সমাজের অবস্থা: ১৫-২৪ বছর বয়সী টগবগে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১.৪৬%
  • অগ্নিরথচড়ার স্বপ্ন ও বাস্তবতা: প্রতি বছর প্রায় ৭ লক্ষ গ্রাজুয়েট ‘অগ্নিরথ’ চড়ার স্বপ্ন নিয়ে বের হচ্ছেন, কিন্তু তাদের জন্য চাকরি জুটছে মাত্র ৩ লক্ষের মতো। বাকি ৪ লক্ষ? তারা নীলক্ষেতে গাইড কিনছে, অথবা হতাশায় ডুবছে।

কেন এই হাহাকার?

কারণটা খুব সহজ—‘Skills Mismatch’ বা দক্ষতার অভাব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট ছাপানোর মেশিনে পরিণত হয়েছে। তারা এমন গ্রাজুয়েট তৈরি করছে যারা শেক্সপিয়রের সনেট মুখস্থ বলতে পারে, কিন্তু এক্সেল শিটে ডাটা এন্ট্রি দিতে গেলে হাত কাঁপে। ফলে নিয়োগকর্তারা দেশি গ্রাজুয়েট বাদ দিয়ে বিদেশি কর্মী নিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। আমরা হচ্ছি ‘তাত্ত্বিক পন্ডিত’, কিন্তু ‘ব্যবহারিক মূর্খ’।

বঙ্কিমবাবুর নবকুমার বনপথে হারিয়েছিলেন দিকভ্রান্ত হয়ে, কিন্তু আজকের গ্র্যাজুয়েটরা পথ হারাচ্ছে তাদের অর্জিত ‘ডিগ্রি’ আর বাজারের ‘ডিমান্ড’-এর মধ্যে থাকা হিমালয় সমান দূরত্বের কারণে। নিচের টেবিলটি লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, কেন নজরুলের ‘অগ্নিরথ’ আজ বেকারত্বের স্টেশনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে প্রচলিত ডিগ্রি বনাম চাকরির বাজারের বাস্তব চাহিদার এই তালিকাটি বিশ্লেষণ করলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মবাজারের মধ্যে এক বিশাল অসামঞ্জস্য বা 'Mismatch' চোখে পড়ে।

নিচের টেবিলটি লক্ষ্য করলে এই অসামঞ্জস্য আরও পরিষ্কার হবে:

Table: প্রচলিত ডিগ্রি বনাম বর্তমান চাকরির বাজারের চাহিদা (২০২৫ প্রেক্ষাপট)

বিশ্লেষণ বলে মরীচিকার পিছে ছোটা সেই পথিক দল

উপরের টেবিলটি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি আমাদের জাতীয় অপচয়ের দলিল। আসুন একটু গভীরে ডুব দিই:

ক. ডিগ্রির মুদ্রাস্ফীতি (Credential Inflation): নজরুল যে ‘রক্ত-পথের’ কথা বলেছিলেন, আমাদের ছাত্ররা এখন ‘সার্টিফিকেট-পথের’ যাত্রী। পাড়ায় পাড়ায় মাস্টার্স পাস ছেলেমেয়ে, কিন্তু তাদের হাতে কোনো কাজ নেই। সবার হাতেই ডিগ্রি আছে, ফলে বাজারে সেই ডিগ্রির দাম এখন বঙ্কিমচন্দ্রের আমলের কড়ির সমান। অর্থনীতিবিদরা একেই বলেন "Credential Inflation"। এম.এ পাস করে পিয়নের চাকরির জন্য আবেদন করা—এটাই এখন আমাদের ট্র্যাজিক রিয়েলিটি।
খ. বিসিএস-এর ব্ল্যাক হোল মেধার অপচয় (Brain Waste): একজন বুয়েট বা কুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার, যাকে রাষ্ট্র লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে প্রযুক্তি শেখালো, সে যখন বিসিএস দিয়ে পুলিশ বা কাস্টমস ক্যাডারে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়, তখন বুঝতে হবে দেশের ‘কম্পাস’ নষ্ট হয়ে গেছে। নজরুল বর্ণিত ‘সিংহ-শার্দূল’ আজ বনে রাজত্ব না করে নিরাপদ খাঁচায় (সরকারি চাকরিতে) ঢুকতে চাইছে। ইঞ্জিনিয়ার শিখছে লসাগু-গসাগু আর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। এটিই হলো মেধার চরম অপচয় বা "Brain Waste"। যে হাত রোবট বানানোর কথা, সে হাত এখন ফাইল নড়াচড়া করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
গ. গ্লোবাল বনাম লোকাল: আজকের জগৎ ‘গ্লোবাল অগ্নিরথ’-এর। অথচ আমাদের সিলেবাস আজও বঙ্কিমচন্দ্রের আমলের সেই ‘ঝাউবনের দীর্ঘশ্বাস’ হয়েই রয়ে গেছে। বিশ্ববাজার যখন পাইথন, জাভাস্্ক্রিপ্ট, ব্লকচেইন কিংবা ক্লাউড কম্পিউটিং নিয়ে কথা বলে, আমাদের পথিকরা তখন মুখস্থ করছে সুলতানি আমলের কর ব্যবস্থা। ফলে তারা গ্লোবাল মার্কেটে পথ হারাবে—এটাই স্বাভাবিক।

উত্তরণের পথ: বনের পথ চিনে নেওয়া

অন্ধকারের মধ্যেও আলো আছে। আমাদের কিছু তরুণ আজ আর চেনা ‘হাটের পথ’ বা সরকারি চাকরির জন্য বসে নেই। তারা নজরুলের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে— ওগো আমরা পথ হারাইয়াছি, ঘরের পথ হারাইয়াছি, বনের পথ হারাই নাই। — এই ‘বনের পথ’ হলো ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স, ইউটিউব আর স্টার্টআপের জগৎ। তবে যারা এখনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, তাদের জন্য সমাধানের পথগুলো নিম্নরূপ:

ক. শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো: পাঠ্যক্রম হতে হবে বাজারের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আইইআর অধ্যাপকের কৌতুকটি বাস্তবে রূপ না দিয়ে বরং ‘ডিপার্টমেন্ট অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট’ খোলা উচিত।
খ. কারিগরি শিক্ষার জৌলুস বাড়ানো: ভোকেশনাল শিক্ষাকে ‘গরিবের শিক্ষা’ মনে না করে একে আধুনিক করতে হবে।
গ. উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা: নয় (৯) লক্ষ বেকার যদি প্রত্যেকে এক (১) জন করেও কর্মী নিয়োগ দেয়, তবে বেকারত্ব জাদুঘরে চলে যাবে। এর জন্য প্রয়োজন সহজ শর্তে ঋণ ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা।
ঘ. আমলা হওয়ার মোহ ত্যাগ: সবাই রাজা হলে প্রজা হবে কে? সবাই আমলা হলে দেশ গড়বে কে? এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

তারা জানে প্রথাগত ক্যারিয়ারের পথ আজ রুদ্ধ, তাই তারানিজেরাই নিজেদের পথ তৈরি করছে। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা যেমন বনের মাঝে পথ দেখিয়েছিল, তেমনি এই ডিজিটাল স্কিলগুলো আজ তরুণদের গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে। তারা বিসিএস-এর মন্দিরে বলি না হয়ে বরং বিশ্ববাজারের ‘অগ্নিরথে’ চড়ে ঘরে বসেই ডলার আয় করছে। তারা কারো ‘মামা-খালুর’ দয়ায় বেঁচে নেই, তারা নিজেদের মেধার জোরে বেঁচে আছে।

[Enjoy the theme Song 🎵 পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো? | Lok-Rock Satire Song | Lyric Video | অধিকারপত্র সম্পাদকীয় সিরিজ]

পথ কি তবে মিলবে? উপদেষ্টা সম্পাদকের শেষ কথা

এখানে রাষ্ট্রের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। রাষ্ট্র যখন দর্শকের ভূমিকায় থাকে, তখন অযোগ্য আর দুর্বৃত্তরাই মঞ্চের নায়ক হয়ে ওঠে। এখনই থামার এবং ভাবার সময়। শিক্ষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে জাতি টিকে থাকে না; তেমনি উদ্যোক্তা তৈরি না হলে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তিও আসে না। পথিক এখন পথ হারিয়ে বিসিএসের পানে। বিসিএসের পেছনে অন্ধের মতো ছুটে আমরা কি তবে এক গভীর অন্ধকারের দিকেই হাঁটছি? এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর—১৮০ ডিগ্রি বাঁক বদলের।

বঙ্কিমচন্দ্র আর নজরুলের সেই 'পথ হারানো'র দর্শন আজ আমাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নীতির আয়না। আমরা একদিকে তরুণদের 'অগ্নিরথ'-এর স্বপ্ন দেখাচ্ছি, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগগুলোকে 'কাপালিকের' হাতে তুলে দিচ্ছি। আমরা তাদের হাতে ডিগ্রি দিচ্ছি, কিন্তু কর্মদক্ষতা দিচ্ছি না।

নজরুল বলেছিলেন, “হাটের পথিকের পায়ে-চলার পথ আমাদের জন্য নয়।” আজকের বিচারে এর অর্থ হলো—সবার মতো গতানুগতিক ডিগ্রির হাটে ভিড় না করে নিজেকে স্পেশালাইজড স্কিলে দক্ষ করে তোলা। বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা যেমন দুর্গম বন চিনেছিলেন, আমাদের তরুণদেরও চিনে নিতে হবে এই ডিজিটাল বনানীর নতুন নতুন গলি।

হে তরুণ পথিক, নীলক্ষেতের মোড়ে দাঁড়িয়ে বা ঢাবি লাইব্রেরির লাইনে দাঁড়িয়ে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলো না। তোমার ম্যাপ (Map) ভুল হতে পারে, কিন্তু তোমার কম্পাস (Talent) ঠিক আছে। শুধু প্রয়োজন সেটাকে সঠিক দিকে ঘোরানো। মনে রেখো, পথিক যদি সময়ের সাথে মানচিত্র (Skill Set) আপডেট না করে, তবে বঙ্কিমী ট্র্যাজেডি আর নজরুলের ‘রক্ত-জবার জীবন্ত কাতরানি’ কোনোটিই এড়ানো সম্ভব হবে না।

কপালকুণ্ডলার সেই প্রশ্নটি যেন হতাশা থেকে নয়, বরং সফলতার পর কেউ আমাদের করতে পারে— পথিক, তুমি তো অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়া আসিয়াছ!”

নজরুলের ভাষায় শেষ করি— পথ হারাই নাই দেবী! ওই মেধা-চিহ্নিত কর্ম-পথই সমাজ জাগাবার পথ।

(আপনার মতামত আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। কমেন্ট বক্সে জানান আপনার ভাবনা। তবে অনুরোধবিনা কারণে রিলস বা অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও শেয়ার করবেন না!)

প্রফেসর মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#BCS_Reality #Unemployment_BD #SkillGapAnalysis #EducationMismatch #Freelancing #YouthCareer #BangladeshEconomy #EditorialFeature #RamyaSahitya #CareerGuidance2025



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: