—সম্পাদকীয় বিশেষ কলাম (Editorial Feature Column) | চতুর্থ পর্ব
ঢাকার ফ্লাইওভার ও গণপরিবহন ব্যবস্থার সংকটকে বঙ্কিমচন্দ্র ও নজরুলের সাহিত্যিক আয়নায় তুলে ধরা হয়েছে এই সম্পাদকীয় বিশেষ কলামে। উন্নয়ন প্রকল্পের চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যাত্রী দুর্ভোগ, ট্রাফিক জ্যাম, সড়ক নিরাপত্তাহীনতা ও অবকাঠামোর বৈষম্য এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে মানবিক ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
বঙ্কিমচন্দ্রের সেই ঝাউবন আজ কংক্রিটের জঙ্গল। যেখানে নবকুমার পথ হারিয়ে কপালকুণ্ডলার দেখা পেয়েছিলেন, সেখানে আজ আপনি পথ হারাবেন হাজারো বাসের হর্ন, ফ্লাইওভারের ভুল ডাইভারশন আর ধুলোর আস্তরণের মাঝে। বঙ্কিমের রোমান্টিক 'পথ হারানো' আর নজরুলের 'দুর্দিনের যাত্রী'র সংগ্রাম যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ঢাকার রাজপথে। আজ বাংলাদেশের গণপরিবহন ও অবকাঠামো খাতের এক ময়নাতদন্ত করা যাক সেই চিরন্তন সাহিত্যের আয়নায়।
১. জ্যামের 'তাতা থৈথৈ' ও নজরুলের তান্ডব নৃত্য
কাজী নজরুল ইসলামের সেই বর্ণনা মনে আছে? "কী আনন্দ কী আনন্দ কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ..."। ঢাকার রাস্তায় জ্যামে আটকে থাকলে আপনার মনে হবে আপনি নজরুলের সেই "তান্ডব নৃত্যের" মাঝখানে পড়ে গেছেন। বাসের হেল্পাররা যখন দরজায় থাপ্পড় মেরে সুর করে ডাকে, তখন মনে হয় যেন কাপালিকের মন্দিরে পূজার বাদ্য বাজছে— "উত্তরা-উত্তরা-উত্তরা!"
বঙ্কিমচন্দ্র যদি আজ মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে জ্যামে পড়তেন, তবে তিনি গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পাশের রিকশাযাত্রীকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতেন, "পথিক, তুমি কি জ্যামে পথ হারাইয়াছো? নাকি জীবনটাই এখানে থমকিয়া গিয়াছে?" আমাদের গণপরিবহন আজ এমন এক 'অরণ্য', যেখানে বাঘের বদলে আছে বেপরোয়া লোকাল বাস, যারা যাত্রীদের পকেট আর সময়—দুই-ই ছিঁড়ে খায়।
২. অবকাঠামোর 'অগ্নিরথ' ও নীচের অন্ধকার
নজরুল লিখেছিলেন, "আকাশ থেকে অগ্নিরথ নেমে এল। বলিদানের তরুণরা তাতে চড়ে যখন ঊর্ধ্বে উঠে যেতে লাগল..."। আমাদের দেশে এই 'অগ্নিরথ' হলো মেট্রোরেল আর মেগা প্রজেক্টের ফ্লাইওভারগুলো। ওপর দিয়ে যখন মেট্রোরেল শোঁ শোঁ করে চলে যায়, তখন মনে হয় আমরা সত্যিই নজরুলের সেই আধুনিক যুগে পৌঁছে গেছি।
কিন্তু রথের নীচেই কি আছে? নীচে আছে ভাঙাচোরা রাস্তা, জলজট আর খানাখন্দ। বঙ্কিমের নবকুমার যেমন নদীর ধারে একা পড়েছিলেন, তেমনি ফ্লাইওভারের নীচের সাধারণ পথচারীরা আজ ব্রাত্য। ওপর দিয়ে অগ্নিরথ চলে যায়, আর নীচে সাধারণ মানুষ ধুলোবালি মেখে নজরুলের সেই "রক্ত-ভুখারিনির" মতো বায়ুদূষণে নীল হয়। এটিই হলো আমাদের অবকাঠামোর 'হাই-টেক রোমান্টিকতা' ও 'অ্যানালগ ট্র্যাজেডি'।
৩. যোগাযোগ খাতের এক্স-রে: এক নজরে পরিসংখ্যান
কেন আমাদের পথিকরা প্রতিদিন রাস্তায় 'বলি' হচ্ছে? নিচের টেবিলটি আমাদের অবকাঠামোর প্রকৃত হালহকিকত তুলে ধরে:

৪. কাপালিকের খড়্গ ও ফিটনেসবিহীন বাস
নজরুলের সেই মন্দিরে "টপটপ করে কাঁচা খুনের ধারা" পড়ার বর্ণনাটি আজ আমাদের সড়কের প্রতিদিনের চিত্র। ফিটনেসবিহীন একেকটি বাস যেন কাপালিকের সেই "বিজয়-কৃপাণ" বা খড়্গ। ব্রেকহীন বাসের চাকার তলায় যখন কোনো শিক্ষার্থীর প্রাণ যায়, তখন নজরুলের সেই লাইনটি হৃদয়ে বিঁধে— "রক্ত-পাগলি বেটির পায়ের চাপে শিব আর্তনাদ করে উঠল।" আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বা 'শিব' আজ পরিবহন সিন্ডিকেটের শবের নিচে চাপা পড়ে আছে।
বঙ্কিমচন্দ্র হয়তো বলতেন, "হে কর্তৃপক্ষ, তোমরা কি কেবল অবকাঠামোর কঙ্কাল গড়িতেছো? এই কঙ্কালের মাঝে প্রাণের নিরাপত্তা কোথায়?"
শেষ কখা: সঠিক পথের সন্ধান কি মিলবে?
নজরুল বলেছিলেন, "ছেড়ে দে বেটি, ছেড়ে দে শিবকে, কল্যাণকে উঠে দাঁড়াতে দে।" আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কেবল মেগা প্রজেক্টের 'রক্ত-পূজার মন্দির' না বানিয়ে সাধারণ মানুষের কল্যাণের পথে নিয়ে আসতে হবে। বঙ্কিমের নবকুমার যেমন শেষে ঘর পেয়েছিলেন, আমাদের প্রতিদিনের যাত্রীরাও চায় নিরাপদে ঘরে ফিরতে।
উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে আমাদের শেষ কথা— ফ্লাইওভারের উচ্চতা দিয়ে নয়, বরং সাধারণ মানুষের যাতায়াতের স্বস্তি দিয়ে উন্নয়নের বিচার করুন। নজরুলের সেই 'অগ্নিরথ' যেন কেবল উচ্চবিত্তের বিলাসিতা না হয়, বরং তা যেন হয় প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের নিরাপদ বাহন।
নজরুলের ভাষায় শেষ করি— "পথ হারাই নাই দেবী! ওই শৃঙ্খলিত নিরাপদ পথই স্মার্ট বাংলাদেশ জাগাবার পথ।"
(আপনার মতামত আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান কমেন্ট বক্সে জানান আপনার ভাবনা। তবে অনুরোধ—বিনা কারণে রিলস বা অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও শেয়ার করবেন না!)
- প্রফেসর ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#ঢাকারগণপরিবহন #ফ্লাইওভারসমস্যা #ঢাকাট্রাফিকজ্যাম #পরিবহনসংকট #নগরঅবকাঠামো #সড়কনিরাপত্তা #মেট্রোরেলবাস্তবতা #স্মার্টবাংলাদেশ #সম্পাদকীয় #বাংলাদেশপরিবহন #ঢাকানগরজীবন #PublicTransportCrisis #DhakaTraffic #UrbanInfrastructure

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: