ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ২৭ চৈত্র ১৪৩১
শবে বরাত শব্দ দু’টি ফারসি। শব অর্থ রাত বা রজনী, বরাত অর্থ ভাগ্য। একসাথে এর অর্থ ভাগ্য-রজনী। বারাআত বললে অর্থ হবে সম্পর্কচ্ছেদ।

কুরআন- হাদিসের আলোকে শবে বরাত!

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ১ মে ২০১৮ ১৯:২৫

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ১ মে ২০১৮ ১৯:২৫

 

আলোকে শবে বরাত – শবে বরাত শব্দ দু’টি ফারসি। শব অর্থ রাত বা রজনী, বরাত অর্থ ভাগ্য। একসাথে এর অর্থ ভাগ্য-রজনী। বারাআত বললে অর্থ হবে সম্পর্কচ্ছেদ। আরবিতে এ রাতকে বলা হয় লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (শাবান মাসের মধ্যরজনী)। শবে কদরকে অনেকে লাইলাতুল বারাআত বলেছেন, শাবানের মধ্যরজনীকে নয়।

শবে বরাতের রাতটি মুসলিম সমাজে গুরুত্বের সাথে পালিত হয়ে আসছে । শবে বরাতের রাতটির সীমাহীন গুরুত্ব ও ফজিলতের কারণেই মুসলিম সমাজ ইবাদত-বন্দেগি করে উদযাপন করে থাকে। এ রাতের ইবাদত-বন্দেগি মহান আল্লাহ খুবই পছন্দ করেন। শবে বরাতের রাতের ফজিলতও অনেক বেশি।

হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বিছানায় না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। জান্নাতুল বাকিতে (মদিনার সর্ববৃহৎ কবরস্থান) গিয়ে তাঁকে পেলাম। তিনি আকাশ পানে মাথা উঁচু করে ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি ভেবেছ, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.) তোমার ওপর জুলুম করবেন? হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি বললাম তেমন কিছু নয়। আমি ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালা নিসফে শাবানের রাতে (শবে বরাতে) সৃষ্টির প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন এবং কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়েও অধিক মানুষকে ক্ষমা করে দেন।(সুনানে ইবনে মাযা, হাদিস :১৩৮৯, মুসনাদে ইসহাক, হাদিস : ৮৫০, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৬০১৭)

০২. আবু মুসা আশআরি রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শাবানের মধ্যরাতে আগমন করে মুশরিক ও ঝগড়ায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ছাড়া সৃষ্টিজগতকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে মাজাহ, ১/৪৫৫, তাবরানি- মুজামুল কাবির ২০/১০৭) আল্লামা বুছিরি বলেন, ইবনে মাজাহ’র হাদিসের সনদ দুর্বল। আল্লামা হাইসামি বলেন, তাবরানির হাদিসের সনদ শক্তিশালী।

০৩. আলী রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন শাবানের মধ্যরাত আসবে তখন তোমরা সে রাতের কিয়াম ও সেদিনের সিয়াম রাখবে। কারণ সেদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা নিচ আকাশে নামেন আর বলেন, ক্ষমা চাওয়ার কেউ কি আছে, যাকে আমি ক্ষমা করব? রিজিক চাওয়ার কেউ কি আছে, যাকে আমি রিজিক দেবো? সমস্যাগ্রস্ত কেউ কি আছে, যে আমার কাছে মুক্তি চাইবে আর আমি তাকে মুক্তি দেবো? এমন কেউ কি আছে? এমন কেউ কি আছে? ফজর পর্যন্ত তিনি এভাবে বলতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ, ১/৪৪৪) আল্লামা বুছিরি বলেন, এ হাদিসের বর্ণনাকারীর মধ্যে ইবনে আবি সুবরাহ আছে, যে হাদিস বানাত। তাই এটি জাল।

প্রথম ও দ্বিতীয় হাদিসের আলোকে অনেক হাদিসবিদ শাবানের মধ্যরাতের ফজিলত আছে বলে মনে করেন। তাদের মধ্যে আছেন ইমাম আহমাদ, ইমাম আওযায়ি, ইমাম ইবন তাইমিয়া, ইমাম ইবনে রজব ও আল্লামা নাসির উদ্দিন আলবানি (র:)।

অন্যদিকে বুখারি (হাদিস নং ১১৪৫) ও মুসলিমের (হাদিস নং ৭৫৮) সহিহ হাদিসের আলোকে অনেক হাদিসবিদ এ রাতের ফজিলত অস্বীকার করেন। তাদের মধ্যে আছেন শায়খ আবদুল আজিজ বিন বাজ (র:) সহ আরো অনেকে।

শাবানের মধ্যরাত কি সত্যি ভাগ্যরজনী? উত্তর না, এ রাত ভাগ্যরজনী নয়। মূলত এ রাতকে ভাগ্যরজনী বলার পেছনে কাজ করেছে আল কুরআনের সূরা আদ দুখানের ৩ ও ৪ নং আয়াত দু’টির ভুল ব্যাখ্যা। এ আয়াতদ্বয়ের তাফসিরে বেশির ভাগ মুফাসসির রমজানের শবে কদরকে বুঝিয়েছেন। ইবনে কাসির ও আল্লামা শাওকানি (র:) ও এ মত প্রকাশ করেছেন। দলিল সূরা আলকদর, আয়াত ০১, সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৮৫। তাই ভাগ্যরজনী হচ্ছে শবে কদর যা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলো।

শাবানের মধ্যরাত উদযাপন করা যাবে কি? এ ব্যাপারে তিনটি মত পাওয়া যায়।

০১. এ রাতে মসজিদে গিয়ে জামাতে সালাত আদায় ও অন্যান্য ইবাদত জায়েজ। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়িয়াহর মত এটি। তিনি কোনো দলিল দেননি।

০২. এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত করা জায়েজ। ইমাম আওজায়ি, ইবনে তাইমিয়া ও ইবন রজব (র:) এ মত পোষণ করেন। তারা এ রাতের ফজিলতের হাদিস দলিল দেন।

০৩. এ রাতে এ ধরনের ইবাদত সম্পূর্ণরূপে বিদআত। চাই তা ব্যক্তিগত হোক বা সামষ্টিক হোক। ইমাম আতা ইবনে আবি রাবাহ, ইবনে আবি মুলাইকা, মদিনার ফুকাহাগণ, ইমাম মালেকের ছাত্রসহ অনেক বিদ্বানের মত। তারা বলেছেন, এ রাতে রাসূলুল্লাহ সা: কোনো নির্দিষ্ট ইবাদত করেছেন বলে সহিহ হাদিসে প্রমাণিত হয়নি। তাঁর সাহাবি থেকেও কিছু বর্ণিত হয়নি।

শায়খ আবদুল আজিজ বিন বায (র:) বলেন, এ রাতের ফজিলত বর্ণনায় কিছু দুর্বল হাদিস এসেছে, যার ওপর ভিত্তি করা বৈধ নয়। আর এ রাতে সালাত আদায়ে বর্ণিত সব হাদিসই জাল। আলেমরা এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।’ (সূরা আল মায়িদাহ: ৩)

রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে আমার দ্বীনে এমন কিছুর উদ্ভব ঘটাবে, যা এর মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২৬৯৭)

এ রাতে হাজারি সালাত নামে এক সালাতের প্রচলন দেখা যায়। প্রতি রাকাতে ১০ বার করে সূরা ইখলাস পড়া হয়। এ সালাত সম্পর্কে আলেমদের মত হলো- এটা বিদআত। কারণ এ ধরনের সালাত রাসূলুল্লাহ সা:, খলিফা ও সাহাবিরা কেউই পড়েননি। হাদিসের কিতাবেও এ সালাতের বর্ণনা আসেনি।

এ রাতের পর দিন সিয়াম বা রোজা রাখা যাবে কি? উত্তর- সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত রাসূলুল্লাহ সা: শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৯৬৯, ১৯৭০, সহিহ মুসলিম হাদিস নং ১১৫৬, ১১৬১)

এ হিসাবে শাবান মাসে রোজা রাখলে সুন্নাহ হবে। শাবানের শেষ দিন ছাড়া বাকি যেকোনো দিন রোজা রাখা জায়েজ। শাবানের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতে পারেন। শুধু ১৫ তারিখ রোজা রাখা বিদআত হবে। কারণ শরিয়তে

এ দিনের সিয়ামের কোনো দলিল নেই। এ দিনে রোজার ব্যাপারে যে হাদিস দলিল দেয়া হয় তা সম্পর্কে আল্লামা বুছিরি বলেন, এ হাদিসের বর্ণনাকারীর মধ্যে ইবনে আবি সুবরাহ আছে- যে হাদিস বানাত। তাই এটি জাল। রাসূলুল্লাহ সা: শুধু রমজানে পুরো মাস রোজা রেখেছেন। এর পরই শাবানে বেশি রোজা রেখেছেন, পুরো মাসের অল্প কয়েকদিন ছাড়া। আমরাও শাবানে বেশি বেশি রোজা রাখতে পারি।

পরিশেষে বলা যায়, শাবানের মধ্যরাত সম্পর্কে দ্বিমত রয়েছে, একদল হাদিসবিদ এর ফজিলত আছে বলে মনে করেন, অন্যদিকে আরেক দল হাদিসবিদ এর ফজিলত অস্বীকার করেন।

লেখক : মো: মাসুম বিল্লাহ বিন রেজা, প্রভাষক শাহ মখদুম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

jana ojana



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: