ঢাকা | শনিবার, ৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২
তোহফায়েল আহমেদ এর স্মৃতিচারন

মার্চের উওাল দিনগুলো

tofayel ahmed | প্রকাশিত: ৩ মার্চ ২০১৯ ০২:৩০

tofayel ahmed
প্রকাশিত: ৩ মার্চ ২০১৯ ০২:৩০

মার্চ' আমাদের স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১-এর মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি যেমন আমাদের ভাষার মাস, মার্চ তেমনি আমাদের স্বাধীনতার মাস। '৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে '৭১-এর ছাব্বিশে মার্চ পর্যন্ত জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি দিনই ছিল সংগ্রামমুখর। আর '৭১-এর মার্চ মাসের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত ছিল বৈপ্লবিক। প্রতি বছর মার্চ মাস এলেই মননে-চেতনায় ভেসে ওঠে উত্তাল রক্তঝরা সেই দিনগুলোর কথা। মনে পড়ে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী প্রজ্ঞা আর জাতীয় চার নেতার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে এবং তাদের নির্দেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, বিচ্ছিন্নতাবাদের দায় এড়িয়ে, কী করে আমরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্ত করেছিলাম প্রিয় মাতৃভূমিকে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এই দুই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু'দফা আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, 'আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট খুব শিগগিরই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে সম্মত হয়েছেন।' অন্যদিকে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া সাংবাদিকদের বলেন, 'দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তার সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা পুরোপুরি সঠিক।' ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান এবং সেখানে জেনারেলদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন।

মূলত লারকানা বৈঠকেই নির্বাচনী ফলাফল বানচালের নীলনকশা প্রণীত হয়। অতঃপর জানুয়ারির শেষ দিকে ভুট্টো তার দলবলসহ ঢাকায় আসেন এবং জানুয়ারির ২৭ ও ২৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র ৬ দফা ভিত্তিক হবে বলে জানান। ভুট্টো বলেন, 'আরও আলোচনার প্রয়োজন'। তিনি ফেব্রুয়ারির শেষ দিকের আগে পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের বিরোধিতা করেন। এরপর ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে এক সরকারি ঘোষণায় জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ৩ মার্চ বুধবার ৯টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন। এদিকে ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। ওয়ার্কিং কমিটি আলোচনা অনুমোদন করে এবং বঙ্গবন্ধুকে 'জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য যেকোনো পন্থা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে।'

১৫ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চক্রান্তকারীদের এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন যে, 'ফ্যাসিস্ট পন্থা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখুন। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার যেকোনো উদ্দেশ্যে তৎপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারীগণ আগুন নিয়ে খেলবেন না।' তিনি বলেন, 'দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেওয়া অধিকারবলে আমরা ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করব। সাত কোটি বাঙালির বুকে মেশিনগান বসিয়েও কেউ ঠেকাতে পারবা না।'

অন্যদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'আওয়ামী লীগের ৬ দফার ব্যাপারে আপস বা পুনর্বিন্যাসের আশ্বাস পাওয়া না গেলে তার দল জাতীয় পরিষদের আসন্ন ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না।' ১৭ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার পার্টি অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, '৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিপল্‌স পার্টির জন্য তাতে যোগদান করা একেবারেই অর্থহীন।' এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, 'আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনী- দেশে এই তিনটি শক্তিই আছে, আমরা কোনো চতুর্থ শক্তির কথা স্বীকার করি না।' জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানান। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ৫ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সম্ভবত ১৭ জানুয়ারি লারকানা বৈঠক ও ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকেই বাঙালি হত্যার চক্রান্ত ও নীলনকশা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। পিন্ডি থেকে করাচি ফিরে গিয়ে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন, 'জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা তার নেই।' ক্রমেই এটা স্বতঃস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তানের সামরিক চক্র '৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির অকুণ্ঠ রায়কে বানচাল করার জন্য ভুট্টোকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করছে এবং জনাব ভুট্টো নিজেও সানন্দে ব্যবহূত হচ্ছেন।

ঘটনার ধারাবাহিকতায় দেখা যায় যে, '৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক রায় বানচালের ষড়যন্ত্র যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, বঙ্গবন্ধু ততই কঠোর-কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছিলেন। ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। সামরিক চক্রের সঙ্গে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত হন, তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ১ মার্চ ভুট্টোর সঙ্গে যোগসাজশে ইয়াহিয়া খান পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। তাৎক্ষণিক ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। '৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরি করার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে মিলিত হবে, জনমনে কাঙ্ক্ষিত এরকম একটি অভিপ্রায়কে সমাধিস্থ করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণায় দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে বাংলার মানুষ, ফেটে পড়ে ক্ষোভে-বিক্ষোভে।

১ মার্চ

এই দিন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'যদি তার পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে ৩ মার্চ অধিবেশন বসে, তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব-নিথর করে দেওয়া হবে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: