
ডেঙ্গু এখন ব্যাপকহারে আমাদের উপর চেপে বসেছে। ইতিমধ্যে জনাবিশেক মূল্যবান জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর মধ্যে দু’জন সম্ভাবনাময় চিকিৎসকও আছেন। একজন নার্সও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। আছে নিস্পাপ শিশুও। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং উদ্বেগজনক। তবে যেকোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করার শক্তি এবং অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সেই শক্তি এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা ডেঙ্গু মোকাবিলা করব। এবং আমরা অবশ্যই একে পরাভূত করব।
অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে ডেঙ্গুর পার্থক্য রয়েছে। সাইক্লোন জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির উপর আমাদের সরাসরি কোন হাত নেই। সেটি পুরোপুরি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু ম্যালেরিয়া ডেঙ্গু ডায়রিয়া প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল করা সম্ভব।
#কি_করে_নির্মূল_সম্ভব?
ডেঙ্গু ভাইরাস কেবলমাত্র এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। আমরা এর জীবনচক্র পরিষ্কার করে জানি। একটি ক্ষুদ্র গন্ডির ভেতর এর চলাফেরা। অতএব এর জীবনচক্র রুখে দেয়া বা ভেঙ্গে দেয়া মোটেই কঠিন না। এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে জন্মলাভ এবং বংশবিস্তার করে। সাধারণত অভিজাত এলাকায় পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এদের পছন্দ । তাই আমরা যদি পণ করি এবং জেদ ধরি যে, আমরা সবাই এডিস মশার বংশবিস্তারের ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করব তাহলে এটা সম্ভব। সকলের সচেতন প্রয়াস এটি সম্ভব করবে। ম্যালেরিয়ার অ্যানোফিলিস মশার মত বিস্তীর্ণ এলাকায় এডিসের বিচরণ নয়। এমনকি সারা বছর ধরে এর প্রকোপও থাকে না। অর্থাৎ একটি ছোট গন্ডির ভেতর একটি ছোট সময় ধরে এডিসের বিচরণ। তাই শিক্ষিত মানুষের একটু সচেতনতাই পারে ডেঙ্গুকে নির্মূল করতে।
আসুন আমরা যার যার বাড়ির এডিসের প্রজনন ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করি। ছোট ছোট জলাশয় যেমন ফুলের টব, ফ্রিজের জমে থাকা পানি, বাড়ির আনাচে কানাচে জমে থাকা ভাঙ্গা বোতল, প্লাস্টিকের পাত্র, ডাবের খোসা, পুরান টায়ার , চিপসের ঠোঙা, পরিত্যক্ত কলস ইত্যাদি খুঁজে বের করি এবং যথাস্থানে ধ্বংস করি। এগুলো আমাকেই করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন আমার বাড়ির ভেতরের পরিবেশ রক্ষা করতে পারবে না।
এডিস মশা সকালে এবং দিবাভাগে সক্রিয় থাকে এবং বেশিরভাগ সময়ে হাঁটুর নীচে কামড় বসায়। অতএব আমরা দিনের বেলায় হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মোজা ব্যবহার করতে পারি। ঘুমন্ত শিশুদের অবশ্যই মশারির ভেতর রাখতে হবে। স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের লম্বা মোজার পাশাপাশি হাতাওয়ালা জামা ব্যবহার করতে বলি। স্কুলের শিক্ষকদের অবশ্যই পাঠদান কক্ষ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।বিদ্যালয় প্রাঙ্গন অবশ্যই স্বাস্থ্যবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে।
ডেঙ্গু মওসুমে কারো জ্বর হলে সেটা গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।ঘরে বসে অপেক্ষা না করে চিকিৎসককে দিয়ে নিশ্চিত হতে হবে। সামান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। তীব্র জ্বরের সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, সারা শরীর ব্যথা, মেরুদন্ড ব্যথা, খাবার অরুচি, বমি এসব ডেঙ্গুর লক্ষণ। সাধারণত চার পাঁচ দিন একটানা জ্বর শেষে হঠাৎ জ্বর কমে যায় এবং পঞ্চম বা ষষ্ট দিনে গায়ে লাল লাল একধরণের দানা বা rash ওঠে। এবং দ্বিতীয়বারের মত আবার জ্বর দেখা দেয়।
তবে ডেঙ্গুর প্রকৃতি এবং পরিণতি সবক্ষেত্রে, সবার ক্ষেত্রে একরকম হয় না। কারো কারো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষেরা উচ্চ ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারেন। আবার বয়স্ক রোগীদের মধ্যে যারা হৃদরোগ, কিডনীরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, ব্রংকাইটিস, স্ট্রোক ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত তাদের ঝুঁকি সর্বাধিক।
#কী_পরীক্ষা_করবেন?
জ্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে CBC এবং Dengue NS1 Ag পরীক্ষা করলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগ ধরা পড়ে। তবে জ্বরের পঞ্চম দিন থেকে CBC, Dengue IgM Ab , SGPT পরীক্ষা করতে হবে।
#কী_করবেন?
আতঙ্কিত হবেন না। আতঙ্ক আপনার কোনো উপকারে আসবে না। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী চিকিৎসক আপনাকে উপদেশ দিবেন। রক্তের কাউন্ট স্বাভাবিক থাকলে বাড়িতে বিশ্রাম নিবেন। জ্বরে মানুষের শরীর থেকে পানি উড়ে গিয়ে পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে। তাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন লিভার, কিডনী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই প্রচুর তরল খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমাতে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ওষুধ দেয়া যেতে পারে। খবরদার জ্বর বা শরীর ব্যথার জন্য ব্যথানাশক ওষুধ (যেমন clofenac, diclofen, ultrafen, voltalin, voltaren, ibuprofen, brufen, inflam, naproxen, indomet, etorix, coxib, disprin ইত্যাদি ) তা মুখে হোক বা মলদ্বারে হোক দেয়া যাবে না।
#ব্যথানাশক_কেন_নয়?
ডেঙ্গু জ্বরে রক্তের জমাটবাধার প্রধান উপাদান অনুচক্রিকা (platelets) কমে যেতে পারে। অনুচক্রিকা দেহের স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহে একটি নিখুঁত ভারসাম্য রক্ষা করে। ডেঙ্গু জ্বরে সেই ভারসাম্যটি ভেঙ্গে পড়তে পারে। প্রায় সবধরণের ব্যথানাশক ওষুধ এই অনুচক্রিকার বিরুদ্ধে কাজ তরে। ফলে মরার উপর খরার ঘা এর মত কমতে থাকা অনুচক্রিকা ব্যথানাশকের আক্রমণে দ্রত অকার্যকর হয়ে রোগীকে রক্তক্ষরণের ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে।
#হাসপাতালে_কখন_ভর্তি_হবেন?
ডেঙ্গু রোগ ধরা পড়ার পর থেকে প্রতিদিন রক্তের CBC পরীক্ষা করতে হবে। যদি দেখা যায় অনুচক্রিকা স্থিতিশীল রয়েছে, রোগী মুখে পর্যাপ্ত খেতে পারছেন তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই । বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিতে পারবেন। যদি অনুচক্রিকা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে এবং রোগীর রক্তচাপ কমতে থাকে, নাড়ির গতি বাড়তে থাকে, মুখে পর্যাপ্ত খেতে পারেন না তাহলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আর যদি দেখা যায় অনুচক্রিকা ধীরগতিতে কমছে তাহলে বাড়িতে বসে প্রতিদিন CBC করতে হবে। অনুচক্রিকা একবার বাড়তে শুরু করলে আর ভয় নেই। ধীরে ধীরে রোগী ভাল হয়ে যাবেন।
#হৃদরোগীরা_কী_করবেন?
যারা হৃদরোগে আক্রান্ত তাদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রক্ত পাতলা করার ওষুধ (যেমন Aspirin, Ecosprin, carva, erasprin, disprin, clopid, Lopirel, odrel, pladex, clontas, clognil, anclog, replet, plavix, clorel, prasurel, ইত্যাদি ) খেতে হয়। এই ওষুধগুলো রক্তের অনুচক্রিকার বিরুদ্ধে কাজ করে এদের কার্যক্ষমতাকে হ্রাস করে দেয়। হৃদরোগীদের জন্য এটি দরকার হয় রক্তনালীর ভেতর অনাকাঙ্খিত রক্ত যাতে জমাটবাঁধতে না পারে। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে কমতে থাকা অনুচক্রিকা যেখানে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় সেখানে এই জাতীয় পাতলা করার ওষুধ রক্তক্ষরণের সম্ভাবনাকে অনেকগুন বৃদ্ধি করে।
সুতরাং হৃদরোগীরা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হবার সাথে সাথে রক্তপাতলা করার সব ওষুধ সাথে সাথে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। ডাক্তারের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রেখে তার নির্দেশমত চলতে হবে। এবং যখনই অনুচক্রিকা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসবে তখন ডাক্তার সবদিক বিবেচনা করে পুনরায় রক্ত পাতলা করার ওষুধ (Aspirin, clopidogrel, Prasugrel ইত্যাদি) শুরু করার পরামর্শ দিবেন।
এছাড়া প্রায়শই দেখা যায় যে, হৃদরোগীদের অনেকের হৃদরোগ ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট ফেইল্যুর এর ওষুধ খেতে হয়। এসব ওষুধ রক্তচাপকে আরো কমিয়ে দিতে পারে। তাই এসব ওষুধ ডাক্তারের সাথে পরামর্শক্রমে সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে।
ডেঙ্গু রোগে অনেকক্ষেত্রে লিভার আক্রান্ত হয়। SGPT, bilirubin বেড়ে যেতে পারে। তাই যারা কোলেস্টেরল কমাবার ওষুধ খান তাদেরকে সাময়িকভাবে এসব ওষুধ বন্ধ রাখতে হবে। যাদের ডায়াবেটিস আছে ডেঙ্গু রোগে তাদের রক্তের সুগার ওঠানামা করতে পারে। তাই ডায়াবেটিসের ওষুধ /ইনসুলিন নেবার আগে ঘন ঘন রক্তের সুগার পরীক্ষা করে ডোজ এ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে।
#কতদিনে_সুস্থ_হবেন?
যত ব্যপকতা নিয়েই ডেঙ্গু আমাদের আক্রমণ করুক না কেন বিপুল অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি নিরাময়যোগ্য রোগ। রক্তের অনুচক্রিকার কাউন্ট একবার বাড়া শুরু করলে আর ভয় নেই। মূল চিকিৎসা হল সাপোর্টিভ ও নার্সিং। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও খাদ্য গ্রহণ করলে এক দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগী কাজে যোগদান করতে পারবেন। অনেক রোগের মত যেহেতু ডেঙ্গু রোগের কার্যকর টীকা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি তাই প্রতিরোধই মূল ফোকাস হতে হবে। সেটি যে কিভাবে সম্ভব তা প্রথমেই বলেছি। যাঁদেরকে হৃদরোগের বিভিন্ন ওষুধ বন্ধ রাখতে হয়েছে তাঁদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার দেখিয়ে পূর্বের ওষুধগুলো পুনরায় শুরু করতে হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: