
মহান ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এসে যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, মানুষের ক্ষোভ যে এতটাই তীব্রতর হয়েছিল, তার পিছনে ছিল দীর্ঘদিনের আন্দোলন। শাসক শ্রেণীর চলছিল নানা ছলচাতুরী, মিথ্যা প্রলোভন। ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে ছাত্র-জনতা এক চরম মুহূর্তে উপস্থিত হয়।
১৫ মার্চ, ১৯৪৮। ঢাকার আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। ভোর থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। ওই বৃষ্টি উপেক্ষা করেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা সংগ্রাম পরিষদ আহূত ধর্মঘটে পিকেটিং শুরু করে। ভাষার দাবিতে সারাদেশ জুড়ে আন্দোলনে পুলিশের যে ধরপাকড় নির্যাতন চলছিল তার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে এই ধর্মঘট চলছিল। সেই ধর্মঘটে শুধু ছাত্ররাই নয়, সচিবালয়ের বাঙালি কর্মচারিরাও অংশ নেন। দুপুরের দিকে এসে যোগ দেন রেল কর্মচারিরা। কিছুক্ষণের জন্য রেল ধর্মঘটও হয়। ছাত্র-জনতার পিকেটিং ধীরে উত্তাল হয়ে উঠছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে, পুলিশ একবার কাঁদানে গ্যাসও নিক্ষেপ করে। কিন্তু সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। এদিন মোহাম্মদ তোয়াহা ও তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্রদের সংগঠিত করেছিলেন। এর আগেই ১১ মার্চ আহূত ধর্মঘট সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জ, গণ গ্রেফতার আগুনে ঘি ঢালার মত ছাত্রদের রাস্তায় টেনে আনে। শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না আন্দোলন, পূর্ব বাংলার সবকটি জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ১১ মার্চের আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন ২০০ জন, গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন ১৮ জন। পুলিশ গ্রেফতার করেছিল ৯০০ জনকে। অনেককে ছেড়ে দেয়া হলেও জেলবন্দী ছিল ৬৯ জন।
১৫ মার্চ ছিল পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের প্রথম অধিবেশন। আগের দিন ১৪ মার্চ রাতে খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সাথে আলোচনায় বসার জন্য ডাক্তার মালিক, তোফাজ্জল আলী ও এমএ সবুরকে এক চিঠি দিয়ে পাঠান কমরুদ্দিন আহমদের কাছে। চিঠিতে তিনি বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে চান। উত্তরে কমরুদ্দিন বলেন, যেহেতু আবুল কাসেম ও তিনি ছাড়া সবাই জেলে সেহেতু কোনো আলাপ চলতে পারে না।’ পরদিন খাজা নাজিমুদ্দিন জানান, তিনি আলোচনা করতে রাজি আছেন এবং তাদের মানতে রাজি আছেন।
ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর সেদিন খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে ‘বর্ধমান হাউসে’ (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) আলোচনা শুরু করেন। নাজিমুদ্দিনের সাথে সংগ্রাম পরিষদের আলোচনায় তুমূল বিতর্ক ও উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পরিষদের সদস্যদের অনমনীয়তার মুখে সবকটি শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু চুক্তি তখনই স্বাক্ষরিত হয় না। জেলে গিয়ে আবুল কাসেম ও কমরুদ্দিন আহমদ বন্দী পরিষদ সদস্যদের চুক্তিগুলো দেখান। এ সময় জেলে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক প্রমুখ এ চুক্তির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা ‘বর্ধমান হাউসে’ ফিরে এলে সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল— সকল রাজবন্দীর মুক্তি, সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সেদিনের অধিবেশনেই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করা হবে বলে প্রস্তাব গ্রহণ এবং সেদিনই আইন পরিষদ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কেন্দ্রের নিকট অনুমোদন সূচক প্রস্তাব গ্রহণ করবে। ১৭ই মার্চ প্রধান জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র ‘আজাদ’-এর প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী স্বীকৃত ঃ চার দিনব্যাপী আন্দোলনের ফলে ভাষা সংকটের সমাধান’।
কিন্তু সেদিনের সেই চুক্তি যে একটি ভাঁওতা ছিল তা বুঝতে দেরি হয়নি। সেদিন অধিবেশনে চুক্তির কোনো কথাই উত্থাপন করা হয়নি। ছাত্ররা অধিবেশনের শেষে তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় পুলিশের লাঠিচার্জে অসংখ্য ছাত্র আহত হন। পরদিনও প্রচণ্ড বিক্ষোভ চলতে থাকে। ১৬ মার্চ সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে ১৭ মার্চ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ও ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। খাজা নাজিমুদ্দিন ভেবেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এলে পরিস্থিতি শান্ত হবে। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমন ও বক্তৃতা পূর্ব বাংলার মানুষের মনে পরিষ্কার ধারণা দিয়ে যায় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে সরকার কোনোরকম ইতিবাচক চিন্তা করছে না। এদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দাবি নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব বাড়ছিল। বাড়ছিল বঞ্চনার বোধ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: