odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 5th November 2025, ৫th November ২০২৫
একটি রূপকধর্মী উপসম্পাদকীয়

নদীর আক্ষেপ: শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমি তোমাদের মবসন্ত্রাসের শিকার- এর শেষ কোথায়?

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৬ June ২০২৫ ২০:০৯

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৬ June ২০২৫ ২০:০৯

আমি একটি নদী। নাম নয়, পরিচয় নয়—আমার শুধু একটি পরিচিতি, আমি প্রবাহমান। আমি জন্মেছিলাম পাহাড়ের গায়ে, ছোট ছোট জলধারার সঙ্গমে। একদিন আমি বয়ে চলতাম গান গেয়ে, আদর পেতাম গ্রামের মানুষের, শ্রদ্ধা পেতাম কৃষকের কাছ থেকে। আমি ছিলাম সভ্যতার জননী। কিন্তু আজ আমি তোমাদের মবসন্ত্রাসের শিকার। আজ আমি জীর্ণ মৃতপ্রায় - তোমাদের মানুষের, তোমাদের সমাজের, তোমাদের মবসন্ত্রাসের কারণে।

তোমরা আজ মবসন্ত্রাস নিয়ে কথা বলছো। কেননা তোমাদেরই একটি শ্রেণি দ্বারা আরেক শ্রেণি মবের শিকার হচ্ছে। কিন্তু আমরা নদীরা যুগ যুগ ধরে এই মবসন্ত্রাসের শিকার হয়ে ফরিয়াদ জানিয়ে আসছি—কখনো ক্ষতবিক্ষত পাড় ভেঙে, কখনো বিষাক্ত জল হয়ে, আবার কখনো নীরব স্রোতে কান্না মিশিয়ে। তবুও তোমরা কর্ণপাত করোনি। আজ তোমরা সরব, কারণ ঘা এখন তোমাদের গায়েই পড়েছে।
তোমরা হয়তো ভুলে যাচ্ছো, একটি সমাজের ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে যদি একটি সূক্ষ্ম বয়নশিল্পের মতো কল্পনা করো, তাহলে মবসন্ত্রাস হলো সেই কর্কশ হাত, যা ধৈর্য, যুক্তি ও আইনের সুতো ছিঁড়ে দিয়ে মুহূর্তে সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। এই করাল থাবা কেবল তোমাদের প্রজাতির একজন মানুষের জীবনই নয়, আমাদের মতো নদীর যৌবনও শেষ করে। এতেই ক্ষান্ত হয় না। তোমাদের সমাজকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অন্ধকারের যুগে, যেখানে সন্দেহই সাক্ষ্য, গুজব-ই বিচার, আর জনরোষই রায়।
তোমাদের দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একাধিক মবসন্ত্রাসের উদাহরণ তোমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কতটা নাজুক হয়ে উঠছে তোমাদের মানবিকতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। কিন্তু তোমরা কি একবারও ভেবে দেখেছো, আমাদের তথা নদীর সাথে যুগ যুগ ধরে কি করেছো?
আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পেছনে রয়েছে একটি গভীর সামাজিক রোগ: লোভ, অবিশ্বাস, আইন-ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, এবং তথ্য যাচাইয়ের সংস্কৃতির অভাব। তোমরা মানুষেরা যখন দেখো অপরাধীরা শাস্তি পায় না, তখন নিজের হাতে ‘বিচার’ নেওয়ার প্রবণতা তোমাদের মাঝে বেড়ে যায়। কিন্তু এই ‘নিজের হাতে বিচার’ আসলে হয় ন্যায়ভ্রষ্ট প্রতিশোধ, যার ফলশ্রুতি আরও ভয়ংকর। নদী ভরাট, দখল, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নিক্ষেপ, বালু উত্তোলনের নামে নদীর বুকে ছুড়ি চালানোর মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিয়ে আমাদের মেরে ফেলার অপচেষ্টা তোমাদের মাঝে যারা চলমাল রেখেছে, বাকীরা দেখেছে তাদের বিচার হয়নি, এতে মবসন্ত্রাসের ভয়াবহতা বেড়েছে। আবার অনেক বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ উৎসাহিত হয়েছে।
আসলে, তোমরা খুবই স্বার্থপর। অদ্ভুত আত্মকেন্দ্রিক। সবকিছুর বিচার নিজের স্বার্থে করে। নিজ স্বার্থের ব‍্যাঘাত ঘটলে, তোমরা জেগে ওঠো।
আসলে তোমরা যখন ক্ষিপ্ত হও, হঠাৎ কোনো গুজবে আতঙ্কিত হও, কিংবা নিজেদের রাগের বিস্ফোরণে হারিয়ে ফেলো মানবিকতা—তখন যাকে সামনে পাও, তাকেই দোষারোপ করো, তারই ক্ষতি করো, তাকেই পিটিয়ে মারো। সেই রক্তাক্ত দৃশ্যের প্রতিধ্বনি আমার ঢেউয়ে বাজে। জানো কি, আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এমন নিষ্ঠুরতা সহ্য করে চলেছি?
তোমরা আমার পাড় দখল করো, আমাকে বাঁধ দিয়ে জখম করো, আমার বুক চিরে বালু তোলো, আমার জলের রঙে বিষ মিশিয়ে দাও। আমি প্রতিবাদ করি না—আমি শুধু কান্না চাপা দিই। আমার গভীরে জমা হয় তোমাদের মতো মানুষের অহংকার, অজ্ঞানতা আর ক্রোধ। জানো তো, এই সহিংসতা কেবল মানুষে মানুষে ঘটে না—তোমাদের সমাজ আমাকে, প্রকৃতিকে, এমনকি ভবিষ্যতকেও মবসন্ত্রাসের হাত থেকে ছাড় দিচ্ছে না।
তোমরা হয়তো অনুভব করতে পারো না, আমাদের প্রতি তোমাদের মবসন্ত্রাসের ভয়াবহতা। মবসন্ত্রাস কেবল একজনের অধিকার খর্ব করে না, গোটা সমাজের জন্য একটি হুমকি হয়ে ওঠে। এটা আসলে তোমাদের সংবিধানে স্বীকৃত মানবাধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত। একটি রাষ্ট্র যেখানে নাগরিককে ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়, সেখানে কারো কথিত অপরাধের বিচার যদি রাস্তার মোড়ে বা জনতার হাতে হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যেমন যুগ যুগ ধরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আমাদের প্রতি হায়েনার মতো তোমাদের ছোবল। আমরা হয়েছি ক্ষতবিক্ষত। তোমাদের সংবিধান আমাদের রক্ষার বাণী শোনায়। কিন্তু তোমরা তা মানে না। আমাদের প্রতি অন‍্যায় করা নগীখেকো অপরাধিরা থেকেছে বিচারের বাইরে। এভাবেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে তোমাদের মাঝে।
একবার ভাবো, যখন একটি শিশুকে ‘চোর’ সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করো—আমার জলে সেই অসহায়ের চোখের কান্না মিশে যায়। যখন একজন নিরীহ বৃদ্ধকে ‘জিন’ বলে গণপিটুনিতে মারো, তখন আমার বুক কেঁপে ওঠে। আর যখন বিচারহীনতায় অভিযুক্তরা হেসে চলে যায়, তখন আমি বুঝে যাই—তোমরা শুধু আমাকে না, নিজের বিবেককেও হত্যা করছো।
তোমরা বলো, “আমরা উন্নত হচ্ছি”—কিন্তু আমি তো প্রতিদিন দেখি, তোমাদের উন্নয়নের নিচে পড়ে থাকে অপমানিত গরিব মানুষ, বিচারহীন শ্রমিক, ধর্ষিতা নারী, ধর্মান্ধতার শিকার সংখ্যালঘু। আমি দেখি, কারো গুজবের খড়গে যেভাবে জনতার ঢল নামে, সেভাবে কেউ আসে না একটি শিশুর গায়ে কম্বল দিতে।
আমার ঢেউগুলো আজ আর খেলাধুলা করে না, তারা বোবা দর্শক। তারা সাক্ষ্য দেয়, কীভাবে তোমরা মানুষ হয়ে, মানুষ হও না।
তবে, আমি এখনো থেমে যাইনি। আমার বুকেও আশা আছে। আমি চাই, আমার পাড়ে যেন আর কোনো নিঃসঙ্গ কান্না ভেসে না আসে। আমি চাই, তোমরা যেন ভেবে দেখো—তোমাদের রাগ, তোমাদের প্রতিশোধ, তোমাদের বিচার নয়—তোমাদের বিবেকই হোক সমাজের চালক।
আমার মতো নদীর প্রতি মবসন্ত্রাস রোধে তোমাদের কেবল আইনি পদক্ষেপ নয়, বরং সমষ্টিগত মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। স্কুল-কলেজে প্মানবাধিকার শিক্ষা, সামাজিক মাধ্যমে তথ্য যাচাইয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর ও স্বচ্ছ হস্তক্ষেপ ছাড়া এই ব্যাধি নির্মূল হবে না।
মবসন্ত্রাসের হিংস্রতা যেদিন থামবে, সেদিন আমি আবার গান গাইব। আবার কলকলিয়ে উঠব শিশুর হাসির মতো, নদী হয়ে নয়—মনুষ্যত্বের প্রতীক হয়ে।
আজ যদি তোমরা চুপ থাক, কাল হয়তো সেই মব তেমাদের দরজায় কড়া নাড়বে। মনে রেখো, নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ।

অধ‍্যাাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: