
রাতের শহরে হঠাৎ একদল মানুষ জড়ো হয়—চোখে আগুন, মুখে ধোঁয়া, এবং হাতে লাঠি। তারা কেউ কাউকে ভালো করে চেনে না, তবুও যেন সকলেই এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। এই সুতোটি আবেগের, হতাশার, কখনোবা প্রতিশোধের। তারা বলে—"বিচার চাই!" অথচ যাকে তারা বিচার দিতে এসেছে, তার মুখে এখনও প্রশ্ন ঝুলে থাকে—"কেন?" এই হলো মব সন্ত্রাস। যেখানে আইন লুকিয়ে পড়ে অন্ধকারে, আর জনতা হয়ে ওঠে স্বঘোষিত ফায়ারিং স্কোয়াড।
মব সন্ত্রাস জন্ম নেয় হঠাৎ, নির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা ছাড়াই। যেন মেঘের গর্জনের মতো, মুহূর্তেই শুরু হয় এক তাণ্ডব। এতে নেই কোনো নেতৃত্ব, নেই কোনো পরিকল্পনা। একা কেউ এমন করতে সাহস পেত না, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে মানুষ নিজেকে বিস্মৃত হয়। নিজের সত্তা মুছে ফেলে সে মিশে যায় এক অচেনা সত্তায়—যার নাম ‘আম-জনতা বা সাধারণ জনগণ’ । সেই জনতা যা আজ ক্ষুব্ধ, আজ উত্তাল, আজ ন্যায়ের মুখোশে ঢেকে নিয়েছে তাদের হিংসার রক্তরঙ।
অন্যদিকে, মব জাস্টিস এক অন্যরকমের নৈরাজ্য। এটি চুপিচুপি জন্ম নেয় সমাজের অভ্যন্তরে—নির্বিকার ক্ষোভ আর দীর্ঘদিনের অবহেলায়। কেউ চুরি করল, কেউ গুজব ছড়াল, কেউ হয়তো সত্যিই অপরাধী—আর তারপরই ছুটে আসে জনতার বিচার। হাতের কাছে যা পায়, তাই দিয়ে শুরু হয় ‘শাস্তি’। আদালত তখন বহু দূরের কোনো কাফেলার মতো মনে হয়—যেখানে পৌঁছাতে গেলে সময়, ধৈর্য আর বিশ্বাস লাগে। কিন্তু যারা পথ হারিয়েছে, তাদের কাছে ধৈর্য বিলাসিতা, আর বিশ্বাস শুধুই প্রতারণার অন্য নাম।
তবে এই দুই প্রবণতার মাঝে এক সূক্ষ্ম রেখা বরাবর ফুটে ওঠে বাস্তবতা। মব সন্ত্রাসের মাঝে থাকে বিক্ষোভ আর অন্ধ প্রতিশোধের ছায়া, আর মব জাস্টিসের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে এক ধরনের বিচারের আকাঙ্ক্ষা—যা কখনোই আদালতের পবিত্রতা পায় না, বরং তা দাঁড়িয়ে যায় নিষ্ঠুর এক অবিচারের কুয়াশায়। এখানে লঙ্ঘিত হয় মানবতার অমোঘ বাণী এবং মহান আল্লাহতায়ালার মানবতা রক্ষার নির্দেশনা।
সমাজ যখন এভাবে উত্তাল হয়, তখন আইনের আসনে বসে থাকে নীরবতা। মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে—"আমরা কি আর বিচার পাব?" এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তারা নিজেরাই হয়ে ওঠে বিচারক, জুরি ও শাস্তিদাতা। অথচ তারা ভুলে যায়, বিচার যখন আবেগে চলে, তখন সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য ঘোলাটে হয়ে যায়। অনেক সময় সেই ঘোলাটে ধারায় ডুবে যায় নির্দোষ প্রাণ, মুছে যায় একটি ভবিষ্যৎ, আর জন্ম নেয় একটি ট্র্যাজেডি—যা কোনোদিনও পূর্ণাঙ্গ দায় স্বীকার পায় না।
এই অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ইতিহাসের দীর্ঘ ছায়া। হাজার বছর ধরে মানুষ শাসনের নানা রূপ দেখেছে—রাজতন্ত্র, ধর্মীয় বিধান, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র। কিন্তু যেখানে শাসন দুর্বল হয়েছে, কিংবা বিচার বিলম্বিত, সেখানে জনতার হাতে আগুন জ্বলে উঠেছে। ইতিহাসের জনক" বা "The Father of History" হিসেবে পরিচিত প্রাচীন প্রাচীন গ্রিক পন্ডিত হেরোডটাস (আনুমানিক ৪৮৪-৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বলেছিলেন, ইতিহাস বোঝে সেই, যে দেখে কিভাবে মানুষ তার ভুলের পুনরাবৃত্তি করে। আর আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও অর্থনীতি শাস্ত্রের জনকদের মধ্যে অন্যতম বিবেচিত মুসলিম পন্ডিত ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ) বলেছিলেন, ইতিহাস শুধু ঘটনা নয়, মানুষের মনস্তত্ত্ব ও সমাজচর্চার দর্পণ। সেই দর্পণে আজ আমরা নিজেরাই দেখছি—এক মুখ, যা রাগে, ক্ষোভে ও অনাস্থায় বিকৃত।
রেনেসাঁর দার্শনিকেরা (যথা:নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, মার্সিলিও ফিকিনো, জিওভান্নি পিকো ডেলা মিরান্ডোলা, জিওর্দানো ব্রুনো, এবং কুসার নিকোলাস প্রমুখ) যেভাবে ইতিহাসকে যুক্তির আলোয় দেখতে চেয়েছিলেন, সেই চেষ্টার বিপরীতে আজ দাঁড়িয়ে এক অন্য বাস্তবতা। যেখানে যুক্তির বদলে রাজত্ব করছে গুজব, তথ্যের বদলে অপতথ্য, ঘটনার বদলে রটনা, এবং আইনের বদলে জনতার চূড়ান্ত রায়। দার্শনিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী জার্মান পন্ডিত কার্ল মার্ক্স (১৮১৮ –১৮৮৩) বলেছিলেন— "ইতিহাস নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি করে—প্রথমে ট্র্যাজেডি হিসেবে, পরে প্রহসন হিসেবে।" আজকের মব জাস্টিস হয়তো সেই প্রহসনেরই এক নির্মম রূপ।
তবু প্রতিকার অসম্ভব নয়। সমাজের গভীরে যদি আমরা আবারও বপন করতে পারি আস্থার বীজ, মানবতার মহান মন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, ধর্মের মহান বাণীতে উদ্ধুদ্ধ করতে পারি, যদি মানুষ বিশ্বাস করে —ন্যায়বিচার সত্যিই সম্ভব— তাহলে হয়তো এই ভয়ঙ্কর প্রবণতাগুলো একদিন মুছে যাবে। কিন্তু বিষযটি জটিল। আইন ভঙ্গে আনন্দ একবার সাধারণ মানুষ পেয়ে বসলে তা অভ্যাসে পরিণত হয়, যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হৈমন্তী' উপন্যাসের সেই অমোঘ বাণী “নরমাংসের স্বাদ যে একবার পাইয়াছে সে কি তাহা ভুলতে পারে?”। আসলেই বিষয়টি বেবে দেখতে হবে।কেননা মানুষ যদি একবার কোনো কিছুতে আসক্ত হয়ে পড়ে, তার পক্ষে সেটা ভুলে থাকা কঠিন, ঠিক যেমন বাঘ একবার নরমাংসের স্বাদ পেলে আর অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তাই একটি সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন এবং জনগণের মননে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠা এখন জরুরি। একইসাথে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা প্রবর্তন করা জরুরি। আর তা করতে পারলেই আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি সেই মব-বিবর্জিত শান্তির আলো, যা এখন শুধু এক ফিকে স্মৃতি।
এই আলো ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও নয়। প্রয়োজন কেবল সঠিক দৃষ্টি, মানবতা বোধ এবং সাহস, যা অন্যায়কে আইন দিয়ে প্রতিরোধ করার স্পৃহা দেয়। কারণ মব কখনোই বিচার দিতে পারে না, কেননা মব কেবল ধ্বংস করতে জানে। আর ধ্বংসের ইতিহাস যারা লেখে, তারা কখনো সমাজ গঠনের ইতিহাস লেখে না। তবে যাইহোক, আজ বিবেকের কাছে প্রশ্ন রয়ে যায়: আমরা কি সেই সমাজ গড়ব, যেখানে প্রতিটি বিচার হবে প্রমাণের আলোয়? নাকি সেই জনতার অংশ হয়ে উঠব, যারা চোখ বুজে বিচার করে, আর পরে তাকিয়ে দেখে ছাই?
লেখক: অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান লিটু, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। odhikarpatranews@gmail.com
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: