ঢাকা | Thursday, 16th October 2025, ১৬th October ২০২৫
ছায়ার বাজারে আলোহীন মানুষের মুখোশ, বাড়ছে অমানুষের ভিড়- একটি অস্থির সময়ের সম্পাদকীয়

অব্যক্ত সমাজ, অনুচ্চারিত সত্য, অহংকারের আগুনে মানবতার নিঃশব্দ ক্ষয়

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৩ September ২০২৫ ২৩:৫৬

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৩ September ২০২৫ ২৩:৫৬

অস্থির সময়ের সম্পাদকীয় 
(বুধবার ০৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, শরৎ-কাল২রা রবিউস সানি ১৪৪৭ হিজরি

ছায়ার বাজারে আলোহীন মানুষের মুখোশ, বাড়ছে অমানুষের ভিড়। অভিমানী সময়ের আড়ালে হচ্ছে নিঃশব্দ ক্ষয়। নগদের রাজ্যে হারানো হৃদয়ের দর্পণ যেন পিরে পাওয়া আজ এক অলীক কল্পনা। অহংকারের আগুনে ছাই হয়ে যাচ্ছে সমাজ।

— আজ সময় যেন অস্থির বাস্তবতার মুখোমুখি। তাইতো মানুষের মধ্যে ক্রমেই জেকে বসছে সম্মানবোধ হারানোর ভয়, বাড়ছে শর্টকাটে ধনী হওয়ার লোভ, আর পেয়ে বসেছে আত্মকেন্দ্রিকতার উন্মাদনা—এই আজব চরিত্রের সমাজকে কেন্দ্র করেই আজকের এই অস্থির সময়ের সম্পাদকীয়। দুর্নীতি, শোষণ আর মূল্যবোধের পতনের অব্যক্ত সত্যে প্রতিধ্বনি তোলে—এই সম্পাদকীয়, যেন এক অদৃশ্য ঘন্টার ধ্বনি।

এই পৃথিবী আজ এক অস্থির ক্যানভাস। পার করছে অপ্রত্যাশিত সময়। আর সম্মুখীন হচ্ছে অপ্রিয় পরিস্থিতির। চারদিকে একটু গভীর দৃষ্টি নিপাত করলেই দেকতে পাওয়া যায়, মানুষ মানুষকে যেন সম্মান দিতে ভুলে যাচ্ছে—মানুষের মাঝে নিজেকে বড় দেখানোর হাহাকার, অপরকে হেয় করার কৌশল, নগদের মোহে নীতি-বিবেক বিসর্জনের প্রতিযোগিতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সাবই নিজের হ্যাডম দেখাতে ব্যস্ত। আমরা এমন এক সময়ের মধ্যে বাস করছি যেখানে ধৈর্যের অবক্ষয় আর শর্টকাটের মোহ মানুষকে দিন দিন করে তুলছে দুর্নীতিগ্রস্ত, অনৈতিক, অমানবিক। মানুষ যেন নিজেই ‘আশরাফুল মাখলুকাত’-এর মর্যাদা ত্যাগ করে, পশুর চেয়েও অধম হয়ে ওঠার এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে—অবনতির সর্বনিম্ন স্তরে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে দিনকে দিন। পরিস্থিতিকে নিচের মতো বলা যায়,

অপরকে কষ্ট দিয়ে ক্ষমা চাইতে সংকোচ হয়—
মনে হয়, ক্ষমা মানে নিজেকে ছোট করা।
কিন্তু অহংকার রক্ষা করতে গিয়ে সম্পর্কের ভিতই ভেঙে পড়ে।
বোঝাপড়ার আড়ালে লুকায় থাকে তীব্র অপমান—
অবচেতন অপচিন্তার ঝড়ে হারিয়ে যায় সম্মানের আবরণ।
ফলে শক্তিমান শোষণ করে দুর্বলকে,
আর দুর্বল নীরবে বিচার তুলে দেয় সৃষ্টিকর্তার দরবারে—
সামান্য শান্তির আশায়।

অনেকেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, আমাদের ডিজিটাল প্রজন্ম পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর ব্যক্তিগত মর্যাদার সীমারেখায় বিশ্বাস করতে শিখেনি। অধিকার রক্ষার বদলে অধিকার কেড়ে নেওয়াই যেন নতুন রীতি হয়ে দাড়িয়েছে। পরিবার ভেঙে একক পরিবারে হয়ে পড়েছে সীমিত জীবন, সহপাঠী হয়ে ছাত্রনং অধ্যয়নং সূত্রে তিন-চার বা তারো বেশি একত্রে থেকেও যেন চেনা হয়ে ওঠে না, ধার দিলে ফেরত না পাওয়া, আর চাইতে গেলে উল্টো ধমক—সবই এক আজব সংস্কৃতির প্রতিফলন। 

স্মোগের ছায়ায় চারপাশে ঘনিয়ে এসেছে স্বার্থপরতা ও অনিয়মের ধোঁয়া—যেখানে মৎস্যনিয়তের মতো বড় মাছ ব্যস্ত ছোট মাছকে গিলে ফেলতে। ‘মব’-এর নামে গড়ে উঠছে দখলদারির সংস্কৃতি, যেখানে অন্যের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়াকে বীরত্ব মনে করা হয়। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছে, যেন জ্ঞানের চেয়ে জোরের মূল্য বেশি। আর কথায় কথায় রাস্তায় নেমে আন্দোলনের নামে জনজীবনে সৃষ্টি করা হচ্ছে দুর্ভোগ—উন্নয়নের পরিবর্তে যেন নৈরাজ্যই হয়ে উঠছে প্রাপ্তির নতুন মানদণ্ড।

শিক্ষায় সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষক হয়ে সমাজকে আলো দেখাতে চান, অথচ নিয়ন্ত্রণ থাকে তাদের হাতেই যারা হয়তো কখনো মেধার সিঁড়িতে উপরে উঠতে পারেনি। রাজনীতির কদর আজ এতটাই বেড়েছে যে, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রাজনীতিতে বা ব্যবসায় প্রবেশ করে হয়ে ওঠে ক্ষমতার কেন্দ্রে, আর প্রথম সারির শিক্ষিতেরা তাদের অধীনে কাজ করেন। এই উল্টো চিত্র এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যঙ্গচিত্র।

সমাজে এখন কৃতঘ্নতার প্রাবল্য। যে সাহায্য করে, সে-ই বেশি অপমানিত হয়। চরিত্রহীনরা চারিত্রিক সনদ দেয়, দুর্নীতিগ্রস্তরা সমাজের অভিভাবক সেজে বসে। নগদ প্রাপ্তিই এখন জীবনের দর্শন—“আজ যা পাব, আজই ভোগ করো।” উপনিবেশিক প্রবাদ বাক্যগুলো যেন রক্তে মিশে গেছে—“কোম্পানির মাল দরিয়ায় ঢাল,” “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।”

ফলে সমাজে দেখা যায়—অন্যায় ঘটে চোখের সামনে, আর আমরা তা ভিডিও করি, কিন্তু থামাতে এগোই না। আত্মকেন্দ্রিকতার এই চরম অবস্থা সামাজিক ন্যায়বিচারকে শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট হচ্ছে, ধর্মের নামে ব্যবসা চলছে, আর মানুষ দিন দিন হয়ে উঠছে আত্মমগ্ন ও অমানবিক।

অদৃশ্য স্মোগ শুধু প্রকৃতির নয়, আজ আমাদের সমাজকেও গ্রাস করছে। চারপাশে এক অদৃশ্য কুয়াশা—যেখানে বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খেতে ব্যস্ত, ক্ষমতার মোহে গড়ে ওঠা মব অন্যের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। মানুষে মানুষে আস্থার জায়গা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, আর ন্যায়ের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যাচ্ছে অরাজকতার কোলাহলে। এই অরাজকতার মাঝেই সবচেয়ে হতাশার বিষয়—শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে দেখা যায়। যারা সমাজের আলোকবর্তিকা হয়ে নতুন প্রজন্ম গড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন, তারাই আজ অবমাননার শিকার। শিক্ষকতার মহিমা যখন রাস্তায় হেয়প্রতিপন্ন হয়, তখন একটি জাতির ভবিষ্যৎও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

আন্দোলনের অধিকার গণতান্ত্রিক সমাজে সবার। কিন্তু কথায় কথায় রাস্তায় নেমে আন্দোলনের নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করাই যখন নিয়মে পরিণত হয়, তখন তা অধিকার নয়, বরং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রতিচ্ছবি। রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, শ্রমিকের রোজগার বন্ধ হয়, রোগী হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে না—তবু আন্দোলনের নামে এই অমানবিকতা চলতেই থাকে।

এমন এক অস্থির সময় যেন সমাজকে শ্বাসরোধ করে রেখেছে। মানুষ ভুলে যাচ্ছে ভ্রাতৃত্ব, ভুলে যাচ্ছে পারস্পরিক সম্মান। ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়ার মতো, যেখানে ক্ষমতার দম্ভই শেষ কথা।

কিন্তু এভাবেই কি সমাজ চলতে পারে? উত্তর অবশ্যই না। প্রয়োজন দায়িত্বশীলতা, প্রয়োজন পারস্পরিক সম্মান ও সহনশীলতা। আন্দোলনকে হতে হবে যুক্তির, শিক্ষকদের হতে হবে সম্মানিত, এবং সমাজকে হতে হবে মানবিক। নইলে স্মোগের মতো এই অস্থিরতা আমাদের চেতনাকে ঢেকে দেবে, আর আমরা হারাবো সেই আলো, যা একসময় বাংলাদেশকে করেছে সংগ্রামী, করেছে অদম্য।

প্রশ্ন জাগে—এ থেকে উত্তরণ কোথায়? উত্তর সহজ নয়, কিন্তু প্রয়োজন একটাই—পারস্পরিক সম্মান আর নৈতিকতার পুনর্জাগরণ। কারণ সমাজ যখন চরিত্রহীনদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন সভ্যতা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। অনুচ্চারিত হলেও এ সত্যটাই আমাদের কানে বাজতে থাকে—অব্যক্ত মানুষই সমাজকে ধ্বংস করে, আর সম্মানই পারে তাকে বাঁচাতে

-অধ্যাপক . মাহবুবুর রহমান লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: