ঢাকা | শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

চবিতে প্রথমবারের মতো 'টেডএক্স চিটাগং ইউনিভার্সিটি' আয়োজিত

চবি প্রতিনিধি | প্রকাশিত: ৪ জুন ২০২৪ ২১:০২

চবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৪ জুন ২০২৪ ২১:০২

চবি প্রতিনিধি:'একটি নতুন আগামী' প্রতিপাদ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক বক্তৃতার আয়োজন 'টেডএক্স চিটাগাং ইউনিভার্সিটি'।

মঙ্গলবার (০৪ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিশারিজ অনুষদের মিলনায়তনে চিটাগং ইউনিভার্সিটি রিসার্চ এন্ড হায়ার স্টাডি সোসাইটির (সিইউআরএইচএস) উদ্যোগে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসময় বিজ্ঞান, গবেষণা, পরিবেশ, অটিজম, বাকস্বাধীনতা, সঙ্গীত, সাহিত্য, পর্বত আরোহণ এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন ৮ জন বিশিষ্টজন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক বেনু কুমার দে, মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিশারিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম, আবুল খায়ের গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার এ এন এম ওয়াজেদ আলী। এছাড়া অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন সিইউআরএইচএসের মডারেটর ও জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান, সিইউআরএইচএস এর উপদেষ্টা ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ড. অধ্যাপক অলক পাল।

তিন শতাধিক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব অংশ নেন। লিড অর্গানাইজার এবং কিউরেটর নুসরাত আফরিন এবং সিলভিয়া নাজনীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আবু তাহের। আয়োজক সিইউআরএইচএস এর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মাহমুদ শরীফ ও কাবেরী দাশ।

অনুষ্ঠানে টেড বক্তা হিসেবে জীবনের গল্প তুলে ধরেন স্বাধীনতা পদক বিজয়ী বিজ্ঞানী অধ্যাপক হাসিনা খান, প্রখ্যাত বিতার্কিক ও উপস্থাপক ডা. আব্দুন নুর তুষার, গীতিকার ও কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব আসিফ ইকবাল, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বাসনা মুহুরি, চবি অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মনজুরুল কিবরিয়া, এভারেস্ট পর্বত আরোহী ডা. বাবর আলী এবং মিস বাংলাদেশ ২০০৭ জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়া।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, কিছু মানুষ এটা চিন্তা করে যে বিশ্ববিদ্যালয় একটা প্রতিষ্ঠান মাত্র। কিন্তু আমি মনে বিশ্ববিদ্যালয় হলো নতুন কিছু উদ্ভাবন করার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নত করতে যতকিছু করার দরকার আমি তা করবো। আমি চাই আমার বিশ্ববিদ্যালয় হোক উদ্ভাবনী শক্তি সম্পন্ন। আমার শিক্ষার্থীদের নব আবিষ্কারকে আমি সবসময় সাধুবাদ জানাই।

তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেশন হাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নতুন আইডিয়া ও আবিস্কারকে সবার সামনে তুলে ধরেছি। আমি সবসময় নতুন আইডিয়া জেনারেটরদের প্রশংসা করি, তাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে সবসময় প্রস্তুত আছি। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

উপ উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক বেনু কুমার দে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন আয়োজন আমাদের স্বপ্ন দেখায় অদূর ভবিষ্যতের। আমরা বহির্বিশ্বের মতো উন্নত দেশে পরিণত হবো। সেই দিন বেশি দেরি নেই।

স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ও পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী গবেষক দলের সদস্য অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বলেন, পাট বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। এটি আমাদের শত বছরের ঐতিহ্য যা আমাদের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের পাট উৎপাদন হয় বাংলাদেশ থেকে। সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের পাটই হচ্ছে সবচেয়ে সেরা। এটি বাংলাদেশের পরিবেশের সাথে মানানসই একটি উপাদান। আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমরা যখন শুরু করি তখন জানতামই না কিভাবে এর জিন বের করতে হয়। পাঠের জিনোম আবিষ্কার আমাদেরকে এতোটা সাহস জুগিয়েছে যার মাধ্যমে ভবিষ্যতেও নতুন নতুন আবিষ্কার করতে আগ্রহ জোগাবে।

বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত আনিসুল হক বলেন, সাধারণত মানুষের পাঁচটি আঙুল হয়ে থাকে কিন্তু লেখক, সাহিত্যিকদের ছয়টি আঙুল। ষষ্ঠ আঙুলটি হলো কলম। খড়ির ঘরে আমার জন্ম। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে দেখলাম এখানে সাহিত্য নাই। কবিতা ছাপানো সহজ করার জন্য আমি সাংবাদিকতা শুরু করি। মানুষ অনেকগুলো কারণে লেখালেখি করে থাকে। ইগোর কারণে লিখে থাকে। আমি নারীর চিত্ত জয় করার জন্য কবিতা লিখতাম। সৌন্দর্যের জন্য মানুষ লিখে। ইতিহাস এর জন্য লেখে। ইতিহাসের প্রতি আমাদের একটা দায়বদ্ধতা থেকেই আমি লিখালিখি করি। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে অনেকে লিখে থাকেন। আমি এই চার কারণে লিখি।

তিনি আরও বলেন, একটি জাতি এগিয়ে যাওয়ার জন্য স্বপ্নের প্রয়োজনীয়তা অনেক। স্বপ্ন ছাড়া কেউ উন্নতি করতে পারেনা। বাংলাদেশের লেখক সবাই মিলে বিশ্বের মধ্যে চলমান বৈষম্য তুলে ধরে সাম্যের কথা বলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে লিখে যেতে হবে।

বিতার্কিক ও উপস্থাপক ডা. আব্দুন নুর তুষার বলেন, আমি ভুল দেখতে পছন্দ করি না, তাই আমি সবচেয়ে বেশি ভুল দেখতে পাই। তাই মানসিকতা যেমন হবে আপনি তেমন পৃথিবীই দেখতে পাবেন। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে কেউ অনুপ্রেরণা দেয় নি। তাঁরা নিজের চিন্তা ভাবনাকে প্রকাশ করেছে। তাই ব্যর্থতা যে সফলতার চাবিকাঠি তা মনে রাখতে হবে।

গীতিকার ও কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব আসিফ ইকবাল বলেন, এটিচিউটড বা মনোভাব হচ্ছে সবকিছুর উর্ধ্বে। আমি মনে করি আমার যোগ্যতা কিংবা জ্ঞানের থেকেও এটিচিউটড বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বাসনা মুহুরি নিজের ছেলের উদাহরণে দেশের অটিজম শিশুদের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা এমন একটি দেশ, সমাজ ও পরিবার চাই যেখানে প্রত্যেকটি মানুষ অধিকার নিয়ে বাঁচবে। একসময় আমার ছেলের জন্য বিভিন্ন ভাবে অপমানিত হতে হতো। কিন্তু এখন মানুষ অনেকটা সচেতন হয়ে গেছে। অটিস্ট্রিক শিশুদের জন্য করুণা না করে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

চবি অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিলো আমাদের নদীগুলো। তবে আজ দুঃখের বিষয় সেই নদীগুলো আজ অবহেলিত। বাংলাদেশের একমাত্র নদী যেটা বাংলাদেশে শুরু হয়ে বাংলাদেশেই শেষ হয়েছে। পৃথিবীর একমাত্র নদী যেটা থেকে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদী থেকে শুধুমাত্র ১ বছরে কন্ট্রিবিউট অর্থনীতিতে ৮ কোটি টাকা। এটা চট্টগ্রামের লাইফ লাইন। প্রতিদিন হালদা নদী থেকে ১৮ লক্ষ্য লিটার পানি সংগ্রহ করা হয়। আমি হালদা পাড়ের সন্তান। আমি যখন ৮ম শ্রেণীতে পড়ি আমার স্কুল টিচার আমাকে একটি কবিতা লিখতে বলেছিলেন। আমি লিখেছিলাম হালদা নদী কবিতাটি। আমরা দূষণমুক্ত নদীর উদাহরণ দিতে গিয়ে লন্ডনের টেমস নদীর উদাহরণ দেই। কিন্তু আমরা অতি শিগগিরই হালদা নদীকে উদাহরণ দিতে পারবো দূষণমুক্ত নদী হিসেবে। 'নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।' শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা নদী নিয়ে সচেতনতা তৈরি করি। হালদা নদী নিয়ে আমাদের সাকসেস হলো বঙ্গবন্ধু মৎস হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান।

এভারেস্ট জয়ী ডা. বাবর আলী বলেন, হালদা পাড় থেকে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানো মোটেও সহজ ছিলো না। আমার দেশের পাহাড় বান্দরবান থেকেই ক্লাইম্বিং শুরু করেছিলাম। মাউন্টেইন ক্লাইম্বিংকে মানুষ একটা স্পোর্টস হিসেবে না বরং জীবনাদর্শ হিসেবে দেখে থাকেন।
তিনি আরও বলেন, যখন আমি কোনো পাহাড়ে উঠতে যাই তখন এটাকে শুধু একটি যাত্রা নয়, তীর্থযাত্রা মনে করি। যখন পাহাড়ে উঠি তখন নিজেকে একদম ছোট্ট মনে হয়। এই জিনিসটি আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। সবাইকে মাউন্টেন এভারেস্ট জয় করতে হবে এমন কোনো কথা নয়, প্রত্যেকের নিজের লাইফে অনেক মাউন্টেইন রয়েছে সেগুলো জয় করুন।

পিয়া জান্নাতুল বলেন, জীবনটা আমার কাছে একটি প্রতিযোগিতা নয়, আমার কাছে এটি একটি ক্যাটওয়াক। ছোটবেলায় আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন আমি একটা লস প্রজেক্ট! জীবিনের এই পর্যায়ে এসে আমি তাদেরকে বলতে যে না আমি বা মেয়ে হিসেবে জন্মানো কোনো লস প্রজেক্ট না।
তিনি আরও বলেন, আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমি কিভাবে এতোকিছু একসাথে ম্যানেজ করি তাহলে আমি বলতে চাই 'টাইম ম্যানেজমেন্ট' সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি এমন একটি কনজার্ভেটিভ ফ্যামিলি থেকে এসেছি যেখানে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখাটাকে খুবই খারাপভাবে দেখা হতো। আমি যতটা-না আমার কাজের জন্য ফেমাস হয়েছি তার চেয়ে বেশি বিভিন্ন ইস্যুতে ভাইরাল হয়ে খ্যাতি অর্জন করেছি।

আয়োজনের মুল পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলো আমা কফি, সহযোগিতায় ছিলো এমবিএ এসোসিয়েশন চিটাগং ইউনিভার্সিটি, কনফিডেন্স সল্ট, স্টেলার ও হাবিব তাজকিরাজ। বেভারেজ পার্টনার হিসেবে ছিলো পুষ্টি, হোয়াইট রেবিট, লোণস্টার স্টেক হাউজ, চিলক্স। সহযোগিতায় একাডেমিক পার্টনার হিসেবে ছিলো দি ইংলিশ একাডেমী এবং ক্রিয়েটিভ আইটি ইন্সটিটিউট, হেলথকেয়ার পার্টনার হিসেবে এসপেরিয়া হেলথকেয়ার, ট্রাভেল পার্টনার হিসেবে ইউএস বাংলা এয়ারওয়েজ। এছাড়া মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিলো সময় টিভি, চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর, দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস এবং দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে চিটাগং ইউনিভার্সিটি রিসার্চ অ্যান্ড হায়ার স্ট্যাডি সোসাইটি বিভিন্ন কার্যক্রম করে আসছে। সংগঠনটি গবেষণা ও উচ্চশিক্ষামূলক বিভিন্ন সেশন, সেমিনার, কর্মশালা, প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীদের আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে আয়োজন করে পৃথিবীর খ্যাতনামা বক্তৃতার অনুষ্ঠান টেডএক্স। সংগঠনটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষাঙ্গনে গবেষণা কার্যক্রম প্রসারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: