odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Tuesday, 21st October 2025, ২১st October ২০২৫
ন্যায্যতার দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েটরা। অধিকার থেকে বঞ্চিত—রাষ্ট্রের নীরবতা কি ন্যায়সংগত?

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ: বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা রাজপথে—রাষ্ট্র কি শুনতে পাচ্ছে?

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২১ October ২০২৫ ১১:০৫

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২১ October ২০২৫ ১১:০৫

উপদেষ্টা সম্পাদকের বিশেষ প্রতিবেদন| ঢাকা, ২১ অক্টোবর ২০২৫

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যখন দেখি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী, সংগ্রামী, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে বসে আছে। কেউ দেখছে না, কেউ শুনছে না। রাষ্ট্র যেন নির্বাক। সমাজ যেন চুপ। আর আমরা? আমরা শুধু পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি।

আমরা অপরাধ করেছি—কারণ আমরা স্বাভাবিক নই!”

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েট আলী হোসেনের কণ্ঠে ক্ষোভ আর কান্না একসাথে মিশে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করা এই মেধাবী তরুণ বলেন, “আমার বাবা-মা অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু এখন আমি বেকার। চাকরির ইন্টারভিউতে গেছি, আর অপমান নিয়ে ফিরে এসেছি।” তাঁর চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু যেন পুরো সমাজের বিবেককে ধিক্কার জানাচ্ছে।

শুধু আলী নয়, শত শত প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট এখন রাস্তায়। শুধু একটি দাবিতে—চাকরিতে তাদের জন্য সংরক্ষিত ১% কোটার বাস্তবায়ন

রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি শুধুই কাগজে?

বাংলাদেশের সংবিধান, উচ্চ আদালতের রায়, এমনকি আন্তর্জাতিক চুক্তি—সবই বলে প্রতিবন্ধীদের অধিকার দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সেই অধিকার যেন এক ধরাছোঁয়ার বাইরের স্বপ্ন। সরকারের বিভিন্ন দফতরে হাজারো আবেদন জমা পড়েছে, কিন্তু নিয়োগ প্রায় শূন্য। কাগজে-কলমে সংরক্ষিত কোটা বাস্তবে এক নিঃসঙ্গ ঠাঁই।

আমরা করুণা চাই না, অধিকার চাই” — বলছিলেন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গ্রাজুয়েট হাসান আলী। “আমাদের জীবন অন্যদের মতোই। আমরা চ্যাম্পিয়ন। কারণ আমরা সব বাধা পেরিয়ে শিক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করেছি।”

ডাকসু ভিপির সংহতি প্রকাশ

গতরাতে, ২০ অক্টোবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)–এর ভিপি সাদিক কায়েম আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁদের খোঁজখবর নেন এবং সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। তাঁর উপস্থিতি আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে।

তবে এখন প্রশ্ন উঠেছে—তরুণ এই নেতৃত্ব কি সত্যিই পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবেন? নাকি এ আশ্বাসও আগের মতো রাজনৈতিক সৌজন্যতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে?

সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়েরই এখন নজর রাখা প্রয়োজন, যাতে এই আশ্বাস পরিণত হয় দৃশ্যমান ও বাস্তব পরিবর্তনে—শুধু প্রতীকী উপস্থিতি কিংবা কথার আশ্বাস না থেকে।

তাহলে কেন এই বঞ্চনা?

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পরেও যখন চাকরির বাজারে ঠাঁই হয় না, তখন তা শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রেরও পরাজয়। এই অবহেলা যেন উন্নয়নের নামে লুকানো বৈষম্য। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ ঢাবির উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারুক শাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এরা কোনো করুণা প্রার্থী নয়। দেশের উন্নয়নের সহায়ক শক্তি। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন জরুরি।”

রাজপথে প্রতিবাদ—প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই যৌক্তিক আন্দোলনের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া উচিত নয় কি?প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নয়নে কি পদক্ষেপ নেবে এই সরকার? প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য হাইকোর্ট ঘোষিত শতকরা একভাগ কোটা বাস্তবায়নে বিশেষ বিসিএসের ব্যবস্থা করে কি এই সরকার ইতিহাসে স্থান করে নেবে? আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কোর্টের রায় বাস্তবায়ন করবে, নাকি শিক্ষকদের আন্দোলনের মতো এই আন্দোলনকেও দমন করার পথই বেছে নেবে?- আর তাই আজ দেখার বিষয়!

অপরদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম-এর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, চলমান এই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি অবগত নন। বায়ুর গুণগত মান পরীক্ষায় নতুন দিগন্তের সূচনা করা এই রসায়নবিদ শিক্ষক একজন মানবিক মানুষ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে সুপরিচিত। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চান, “ক্যাম্পাসে দু’দিন ধরে চলমান এই আন্দোলনের সংবাদ কি কোথাও এসেছে?”

উত্তরটা করুণভাবে সহজ—সমাজের সর্বস্তরের অপ্রতিবন্ধী মানুষের অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও নেতিবাচক মানসিকতা প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকেও চোখে দেখে না।

আসলে এই আন্দোলনটি জাতীয় মিডিয়ায় শীর্ষ সংবাদ হওয়ারই কথা ছিল। উন্নত ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশগুলোতে এমনই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মিডিয়া অনেক সময় ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত হয়—যেখানে নেতিবাচক ও চমকপ্রদ সংবাদের পেছনে ছুটে চলে ‘কাটতি’ ও ‘ভিউ’-এর আশায়।

ডীন অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম আরও বলেন, “প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। না হলে বৈষম্যহীন, মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন শুধু স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তারা যোগ্যতার ভিত্তিতেই সুযোগ পেয়েছে। তাদের মেধা নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। মহামান্য হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত ১% কোটা পূরণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।” তিনি আরো বলেন, “এই আন্দোলন জাতীয় গুরুত্বের দাবি রাখে। মিডিয়া কাভারেজ না পাওয়ার কারণই আমাদের সমাজের মনোভাব। এটা পরিবর্তন জরুরি।”

সমাধান কী?

  • হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে ১% কোটা বাস্তবায়নের জন্য স্পেশাল বিসিএস আয়োজন।
  • বেসরকারি খাতে প্রতিবন্ধীদের চাকরির নিশ্চয়তায় আলাদা কমিশন গঠন।
  • জাতীয় মিডিয়ার সোচ্চার ভূমিকা।
  • “Nothing about us without us” নীতির বাস্তবায়ন।

১৫% জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না

আজ রাজু ভাস্কর্যে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের চোখে জল, মুখে প্রশ্ন—“আমরা কি এই রাষ্ট্রের নাগরিক নই?” রাষ্ট্র যদি এখনো না শোনে, তবে তার উন্নয়ন আর মানবিকতা—দুইই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে।

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ!
রাষ্ট্র কি শুনতে পাচ্ছে? রাজু থেকে এই কান্না, এই আহাজারি কি যমুনায় পৌঁছবে?

✍️ অধ্যাপক . মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#DisabledRights #DhakaUniversity #InclusionMatters #অধিকারআন্দোলন #১শতাংশকোটা #HridoyeRoktokshoron

উপদেষ্টা সম্পাদকের বিশেষ কলাম তাদের চোখে জল, রাষ্ট্র কি দেখছে?’ পড়তে ক্লিক করুন: তাদের চোখে জল, রাষ্ট্র কি দেখছে? (উপদেষ্টা সম্পাদকের বিশেষ সম্পাদকীয় কলাম)



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: