odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 22nd October 2025, ২২nd October ২০২৫
আইন ও নীতির কাগজে অধিকার থাকলেও, বাস্তবের মাটিতে এখনো অদৃশ্য লাখো প্রতিবন্ধী মানুষ। অন্তর্ভুক্তি কেবল সহানুভূতির নয়—এটি ন্যায় ও মানবতার প্রশ্ন।

লিখিত অধিকার, অলিখিত বঞ্চনা: প্রতিবন্ধী মানুষের অদৃশ্য জীবনের দৃশ্যমান লড়াই

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২২ October ২০২৫ ১৩:১৫

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২২ October ২০২৫ ১৩:১৫

বিশেষ উপসম্পাদকীয়

ঢাকার কেরানীগঞ্জের এক কোণে, ব্যস্ত বাজারের গলির ভেতর ছোট্ট এক চায়ের দোকান। সেখানে বসে আছেন আব্দুল হামিদ (ছদ্মনাম), বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কাঠের চাকার বোর্ডে ভর দিয়ে এগোন তাঁর প্রতিটি সকাল। জন্মগতভাবে দুই পা না থাকলেও, জীবন থেমে নেই তাঁর। চুলার আগুনে ফুটতে থাকা পানির শব্দে মিলেমিশে যায় তাঁর কণ্ঠের এক নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস—“আমার জীবনের অধিকাংশ অধিকার এখনো কাগজেই রয়ে গেছে।”

এই এক বাক্য যেন বাংলাদেশের এক কোটি ষাট লাখ প্রতিবন্ধী মানুষের সম্মিলিত আর্তনাদ। রাষ্ট্রের আইনে তাঁদের অধিকার সংরক্ষিত, কিন্তু জীবনের মাটিতে তা এখনো অধরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান কিংবা সামাজিক অংশগ্রহণ—সবকিছুর পথেই অদৃশ্য দেয়াল।

 আইন আছে, প্রয়োগ নেই

২০১৩ সালে প্রণীত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এক দশক পেরিয়েও এই আইন বাস্তবের মাটিতে শিকড় গাঁড়তে পারেনি।

সরকারি চাকরিতে ১ শতাংশ কোটা থাকলেও তা পূরণ হয় না। বেসরকারি খাতের চিত্র আরও করুণ—কোটা তো দূরের কথা, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি’র শব্দটাই অনুপস্থিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্নাতক তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন—“ডিগ্রি পেয়েছি, কিন্তু চাকরির বাজারে আমার যোগ্যতা নয়, আমার প্রতিবন্ধকতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইন আছে, কিন্তু তার চোখ নেই।”

 শিক্ষা ও অবকাঠামো: প্রথম পদক্ষেপেই ব্যর্থতা

অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা এখনো বাংলাদেশের জন্য এক স্বপ্ন। ক্লাসরুমে ওঠার র‍্যাম্প নেই, লিফট নেই, ব্রেইল বই অপ্রতুল, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ জানা শিক্ষক বিরল।ঢাবির এক প্রাক্তন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বলেন—“প্রতিটি পদক্ষেপেই সমাজ যেন প্রশ্ন করে, তুমি কি পারবে? অথচ আমরা জানি, আমাদের সক্ষমতা আছে—শুধু দরকার সঠিক পরিবেশ।”উচ্চশিক্ষা অর্জন করেও যখন কর্মক্ষেত্রে দরজা বন্ধ থাকে, তখন এই তরুণরা কেবল বেকারই নয়, বঞ্চিত নাগরিক হিসেবেও গড়ে ওঠেন।

 কর্মসংস্থান ও সামাজিক অংশগ্রহণ: অধিকার বনাম দৃষ্টিভঙ্গি

সরকারি খাতের কোটার হিসাব এক, বাস্তবের চিত্র শূন্য। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় বিনা সংকোচে বলে—“অফিসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই, কাজ করতে সমস্যা হবে।” ফলত, মেধাবী তরুণ-তরুণীরা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন চাকরির সারিতে। একজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের ভাষায়—“বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষকে এখনো সহানুভূতির চোখে দেখা হয়, অধিকারের দৃষ্টিতে নয়। এই মানসিকতা না বদলালে কোনো আইন কার্যকর হবে না।” পাবলিক স্থান, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা—সব জায়গাতেই এখনো প্রবেশগম্যতা একটি দূর স্বপ্ন।

উন্নয়নের করণীয়: কাগজ নয়, কাজে প্রতিফলন

  • অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কেবল নীতির প্রশ্ন নয়, এটি রাষ্ট্রের মানবিক দায়বদ্ধতা।
  • কোটা বাস্তবায়নে কঠোর তদারকি: সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রতিবন্ধী কর্মী নিয়োগে স্বাধীন কমিশন গঠন।
  • অ্যাক্সেসিবল অবকাঠামো: স্কুল, হাসপাতাল, অফিস—সবখানে প্রবেশগম্য পরিবেশ ও সহায়ক প্রযুক্তি নিশ্চিতকরণ।
  • ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও দক্ষতা উন্নয়ন: কর্মসংস্থানে প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ডিজিটাল স্কিল প্রোগ্রাম।
  • মনোভাবের পরিবর্তন: মিডিয়া, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রতিবন্ধী মানুষদের দৃশ্যমান করে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো।

অধিকার বনাম বাস্তবতার সংঘাত

বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী অধিকার আজও নীতি ও বাস্তবতার মাঝখানে এক অনন্ত টানাপোড়েন।আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল। সমাজের মানসিকতা এখনো “সহানুভূতি” নির্ভর, “সমান অধিকার” নয়।অবকাঠামোর ঘাটতি ও প্রযুক্তির অভাবে শহর ও শিক্ষালয়গুলো এখনো সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।

বিশ্বদৃষ্টি: অন্তর্ভুক্তির আন্দোলন

বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য—শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ।ই-লার্নিং, ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরি, শহুরে প্রবেশগম্যতা ও সামাজিক সচেতনতা—এই চার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠছে নতুন অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ।এ পথেই প্রতিবন্ধী মানুষরা শুধু স্বাভাবিক জীবন নয়, নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন অর্জনের স্বপ্ন দেখছেন।

নীতি উন্নয়নের করণীয় (Policy & Grassroots Approach)

  1. আইন ও নীতি শক্তিশালী করা: যেমন ADA, DDA, CRPD-এর মতো আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা।
  2. Grassroots Movement সমর্থন: সমাজের স্থানীয় উদ্যোগ ও এনজিওর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি।
  3. প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ: ডিজিটাল স্কিল, অনলাইন শিক্ষা ও অ্যাক্সেসিবল প্রযুক্তি ব্যবহার।
  4. সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন: মিডিয়া, স্কুল, এবং সাংস্কৃতিক উদ্যোগের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা।
  5. সংশ্লিষ্ট নীতি সমন্বয়: সরকারি-বেসরকারি-সামাজিক সেক্টরের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নিশ্চিত করা।

শেষকথা: অদৃশ্য মানুষদের দৃশ্যমান করা

প্রতিবন্ধী মানুষরা বাংলাদেশের নাগরিক, রাষ্ট্রের সন্তান। তাঁদের অধিকার আইন বইয়ের পাতায় আছে, কিন্তু বাস্তবের মাঠে নেই। তাদের দৃশ্যমান করার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়—আমাদের, সমাজের, প্রতিষ্ঠানগুলোর। অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলা মানে শুধু প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা নয়—এটি মানবতার, সমতার, আর উন্নয়নের নতুন  গড়া।আর এই সংজ্ঞা হলো: “প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়ন মানে—সমাজের শক্তিকে পূর্ণতা দেওয়া।” আসলে তাদের প্রতিবন্ধকতা নয়, সমাজের অজ্ঞতা, নেতিবাচক মনোভাব ও অক্ষমতাই আজ সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। তাদের পাশে দাঁড়ানো মানেই—একটি আলোকিত, মানবিক, এবং সমান অধিকারের বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

✍️ অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

আরো পড়ুন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ: বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা রাজপথে—রাষ্ট্র কি শুনতে পাচ্ছে?

#প্রতিবন্ধীঅধিকার #অন্তর্ভুক্তিবাংলাদেশ #InclusiveBangladesh #DisabilityRights #Empowerment #Accessibility #SocialJustice #HumanRightsBD



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: