ডাঃ তৌফিক সুলতান
মাথাব্যথার ধরন ও বৈশিষ্ট্য
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মাথাব্যথাকে সাধারণত দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়— প্রাথমিক (Primary Headache) এবং দ্বিতীয়িক (Secondary Headache)।
প্রাথমিক মাথাব্যথা হলো এমন মাথাব্যথা যার পেছনে অন্য কোনো নির্দিষ্ট রোগ নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ তিনটি ধরন হলো—
১. টেনশন হেডেক (Tension Headache): এটি সবচেয়ে প্রচলিত ধরন। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অনিদ্রা বা অতিরিক্ত কাজের চাপ থেকে সাধারণত এই ব্যথা হয়। মাথার দু’পাশে চাপ বা ভার অনুভূত হয়, যেন মাথা শক্ত করে বাঁধা রয়েছে।
২. মাইগ্রেন (Migraine): এটি এক ধরনের স্নায়বিক সমস্যা। মাথার এক পাশ বা দুই পাশে ধকধক ব্যথা হয়, যা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। বমি বমি ভাব, বমি, আলো বা শব্দে অস্বস্তি এবং দৃষ্টিবিভ্রম (Aura) এই রোগের সাধারণ লক্ষণ।
৩. ক্লাস্টার হেডেক (Cluster Headache): এটি তুলনামূলক বিরল হলেও খুবই তীব্র। চোখের চারপাশে জ্বালাপোড়া ও ব্যথা হয়, সাধারণত রাতের দিকে বা নির্দিষ্ট সময় অন্তর এ ধরনের আক্রমণ দেখা দেয়।
অন্যদিকে, দ্বিতীয়িক মাথাব্যথা হয় শরীরের অন্য কোনো রোগের কারণে। যেমন— সাইনাস ইনফেকশন, চোখের দৃষ্টিজনিত সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্কে প্রদাহ, টিউমার, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা কিংবা আঘাতজনিত জটিলতা।
মাথাব্যথার সাধারণ কারণ
মাথাব্যথার কারণ অনেক বৈচিত্র্যময়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো—
-
মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা
-
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব বা অতিরিক্ত ঘুম
-
পানিশূন্যতা (Dehydration)
-
অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস বা দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকা
-
অতিরিক্ত চা, কফি বা ক্যাফেইন গ্রহণ
-
দীর্ঘক্ষণ মোবাইল, কম্পিউটার বা টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা
-
উচ্চ রক্তচাপ বা হরমোনের পরিবর্তন
-
চোখে পাওয়ার সমস্যা বা দৃষ্টিবিভ্রাট
-
আবহাওয়া পরিবর্তন, অতিরিক্ত রোদ বা শব্দ দূষণ
-
ঘাড় ও কাঁধের পেশীর টান বা অস্বাভাবিক ভঙ্গি
এছাড়া মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিক চক্রের আগে বা গর্ভাবস্থায় হরমোন পরিবর্তনের কারণে মাথাব্যথা দেখা দিতে পারে।
মাথাব্যথা থেকে মুক্তির উপায়
মাথাব্যথা উপশমে প্রথম ও প্রধান করণীয় হলো জীবনযাপন ও অভ্যাসে পরিবর্তন আনা।
১. পর্যাপ্ত পানি পান: শরীরে পানির ঘাটতি মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। প্রতিদিন অন্তত ৮–১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত। বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায় ঘাম ঝরলে শরীরের তরল দ্রুত কমে যায়, তখন স্যালাইন বা ফলের রসও কার্যকর।
২. পর্যাপ্ত ঘুম: ঘুমের অভাব মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ ও স্নায়বিক ভারসাম্য নষ্ট করে। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমানোর আগে মোবাইল, কফি বা ভারী খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
৩. মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা: অতিরিক্ত মানসিক চাপ মাথাব্যথাকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে। নিয়মিত হাঁটা, হালকা ব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন, ধ্যান বা প্রার্থনা মনকে শান্ত রাখে। প্রতিদিন কিছু সময় নিজের পছন্দের কাজ যেমন বই পড়া, গান শোনা বা পরিবারের সাথে সময় কাটানোও মানসিক প্রশান্তি দেয়।
৪. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন: নিয়মিত ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তৈলাক্ত, অতিরিক্ত লবণযুক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার মাথাব্যথা বাড়াতে পারে। সকালে নাশতা না করলে অনেক সময় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে মাথাব্যথা হয়।
৫. চোখের যত্ন: যারা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার বা মোবাইলের সামনে কাজ করেন, তাঁদের চোখের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এজন্য ২০-২০-২০ নিয়ম অনুসরণ করা উচিত— প্রতি ২০ মিনিট পর ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের দিকে তাকান। এটি চোখ ও মস্তিষ্ক উভয়কেই বিশ্রাম দেয়।
৬. ঠান্ডা বা গরম সেঁক: মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে ঠান্ডা সেঁক কার্যকর, আর টেনশন হেডেকের ক্ষেত্রে গরম সেঁক ভালো ফল দেয়। একটি পরিষ্কার কাপড়ে বরফ মুড়িয়ে কপালে বা ঘাড়ে লাগানো যেতে পারে।
৭. শারীরিক ব্যায়াম: নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, যোগব্যায়াম ও স্ট্রেচিং মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ায় এবং রক্তসঞ্চালন উন্নত করে। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ৩০ মিনিট হাঁটা উপকারী।
চিকিৎসা ও পরামর্শ
যদি মাথাব্যথা নিয়মিত হয়, দিনে বারবার হয় বা ব্যথার ধরন পরিবর্তিত হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। অনেক সময় ব্যথানাশক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার নিজেই “মেডিকেশন ওভারইউজ হেডেক” নামক নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই নিজের মতো করে ওষুধ না খেয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
চিকিৎসক সাধারণত রোগীর ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা ও প্রয়োজনে সিটি স্ক্যান বা এমআরআই-এর মাধ্যমে কারণ নির্ণয় করেন। যদি উচ্চ রক্তচাপ, দৃষ্টি সমস্যা বা সাইনাসের সংক্রমণ থাকে, সেগুলোর চিকিৎসার মাধ্যমে মাথাব্যথাও নিয়ন্ত্রণে আসে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে
যদি মাথাব্যথা হঠাৎ শুরু হয় ও অত্যন্ত তীব্র হয়, চোখে ঝাপসা দেখা দেয়, কথা জড়িয়ে যায়, জ্ঞান হারানোর প্রবণতা দেখা দেয়, ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, অথবা কোনো আঘাতের পর মাথাব্যথা শুরু হয়— তখন অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। এগুলো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ইনফ্লামেশন বা অন্য কোনো জটিলতার লক্ষণ হতে পারে।
প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা
মাথাব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি ও ঘুম নিশ্চিত করা, এবং মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা। কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়া, স্ক্রিন টাইম কমানো ও শারীরিক ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়া দীর্ঘমেয়াদে মাথাব্যথার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মাথাব্যথা হলে শুধুমাত্র ব্যথানাশক খেয়ে নিজেকে সাময়িকভাবে স্বস্তি না দিয়ে এর মূল কারণ চিহ্নিত করা। সচেতনতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সঠিক চিকিৎসা অনুসরণ করলেই মাথাব্যথা থেকে স্থায়ী মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: