— উপসম্পাদকীয়: ডিজিটাল প্রজন্মের সাতকাহান!
“নীরব ঢেউয়ের আর্তি — যেখানে আলোর নিচে হারায় মানুষ — Where light itself forgets the face of man” — ডিজিটাল যুগের স্বার্থপরতা, আবেগের অবক্ষয় ও আমিত্বের উন্মাদনা নিয়ে এক গভীর সাহিত্যিক বিশ্লেষণ। প্রযুক্তি ও মানবতার সংঘর্ষে আধুনিক প্রজন্মের নৈতিক ও মানসিক বিপর্যয়ের রূপকচিত্রে আঁকা হয়েছে এই উপ-সম্পাদকীয় । কিভাবে ডিজিটাল সভ্যতার স্রোতে হারিয়ে যাওয়া মানবতা পুন:রুদ্ধার করতে হবে, তা চিন্তার সময় এসছে। আর যে দেরি করা ঠিক হবে না।
বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?
দেশ আজ দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত মোড়ে— যেখানে হাতে স্মার্টফোন, কিন্তু মুঠোর ভেতরে বন্দি আত্মা। চারপাশে কেবল “ডিলিট”, “ব্লক” আর “মিউট”— যেন এই তিন শব্দই হয়ে উঠেছে জাতীয় দর্শন। মানুষ হতে যেখানে একসময় সময় লাগত, মেশিন হতে এখন লাগে শুধু একটিমাত্র বোতামের চাপ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রযুক্তির আলোয় বড় হচ্ছে, কিন্তু এই আলোর ভেতরেই হারিয়ে যাচ্ছে অনুভূতির রঙ, সহমর্মিতার গন্ধ। গুগলের অগাধ জ্ঞানের মাঝেও মানবিকতার খোঁজ দিলে দেখা যায়, ফলাফল আসে “Error 404—Not Found।” মা একদিন বলতেন, “খোকা, মানুষ হ তো,” আর আজ বলেন, “খোকা, ফোনটা রেখে একবার চোখে চোখ রাখ তো!” কিন্তু সেই চোখ এখন স্ক্রিনে স্থির— কারণ আধুনিক বিশ্বাসে বলা হয়, চোখে চোখ পড়লেই নাকি স্ক্রিন অফ হয়ে যায়।
স্বপ্নবাজ এই প্রজন্মের মেধা নিয়ে সন্দেহ নেই; তারা চাইলেই চাঁদের বুকে ঘর বানাতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা লক্ষ্য নয়— সমস্যাটা মনোযোগ। প্রথম সিঁড়ি ভাঙতেই তারা থেমে যায় টিকটকের দরজায়, বলে, “আরও একটু ভাইরাল হই তারপর দেখি।” তাদের স্বপ্নের মানচিত্রে ‘লাইক’ আর ‘সাবস্ক্রাইব’-এর ঘূর্ণি তৈরি করেছে এক বিভ্রান্ত ফ্যান্টাসির ঝড়। স্বপ্ন দেখা দোষের নয়, কিন্তু যখন সেই স্বপ্ন কেবল “রিলস রেডি” আর “স্টোরি রিচ”-এর জন্য তৈরি হয়, তখন তা স্বপ্ন নয়, ফিল্টার করা কল্পনা। এই প্রজন্মের দৃষ্টি যত উপরে উঠছে, হৃদয় তত নিচে নামছে। মেধা আছে, কিন্তু সেই মেধা আত্মার আলো পায় না— কারণ প্রতিটি অর্জনের পরেই তারা খোঁজে ডিজিটাল করতালির শব্দ, বাস্তব প্রশান্তির নয়।
একদিন ঠাকুরদা গল্প বলতেন, আজ সেই গল্প বলে ইউটিউব। পাড়ার আংকেল বলতেন, “এই ছেলে মানুষ হবে”— এখন ফেসবুক বলে, “Suggested for You: ADHD Shorts।” যৌথ পরিবারের ছায়া উধাও, এখন শুধু একক পরিবার আর ডাবল চাকরির ক্লান্তি। সন্তান বড় হচ্ছে আয়ার কোলে, কিন্তু মন গড়ছে মোবাইলের ফ্রেমে। এরা ‘আইপ্যাড কিড’— জন্ম থেকে টাচস্ক্রিনে অভ্যস্ত, ভালোবাসা শেখে রিয়্যাকশন দিয়ে, না যে আলিঙ্গনে। সম্পর্কের ভাষা এখন ইনবক্সে এক্সক্লামেশন মার্ক, মুখোমুখি হলে “Seen but Not Replied।” সবাই বলে, “আমি আলাদা,” কিন্তু কেউ বলে না, “আমি দায়িত্বশীল।” নিজের আমিত্বের পিঠে সেলফি তুলে সবাই আজ সেলিব্রিটি, অথচ কৃতজ্ঞতা যেন হারিয়ে গেছে অভিধান থেকে। প্রেম, বন্ধুত্ব, নৈতিকতা— সবকিছুই ধীরে ধীরে পিক্সেলের ভেতর মুছে যাচ্ছে, যেন মানবতার মুখে চাপা পড়েছে এক অনন্ত ফিল্টার।
ডিজিটাল সভ্যতার স্রোতে হারিয়ে কি হারিয়ে যাচ্ছে মানবতা
আমরা এমন এক যুগে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে আলো আছে কিন্তু উষ্ণতা নেই, সংযোগ আছে কিন্তু সম্পর্ক নেই। প্রযুক্তির ঝলমলে পর্দার ওপারে আমাদের মুখ যেন হারিয়ে গেছে, আর মানবিকতার কণ্ঠস্বর ডুবে গেছে ডাটা ও নোটিফিকেশনের শব্দে। এক ক্লিকেই এখন মুছে যায় সম্পর্ক, এক ইমোজিতেই শেষ হয় অনুভবের ভাষা— সভ্যতার এই প্রবল স্রোতে মানুষ ক্রমে হারিয়ে ফেলছে নিজের মানবিক প্রতিচ্ছবি।
আজকের শিশুরা জন্ম নিচ্ছে ডিজিটাল কোলে, বেড়ে উঠছে সার্কিটের আলোয়, যেখানে দাদির গল্পের জায়গা নিয়েছে ইউটিউব শর্টস, আর মায়ের লোরি হয়েছে মোবাইল অ্যাপের সাউন্ড ট্র্যাক। তারা জানে কীভাবে স্ক্রল করতে হয়, কিন্তু জানে না কীভাবে স্পর্শ করতে হয়; জানে কিভাবে রিঅ্যাকশন দিতে হয়, কিন্তু বোঝে না কিভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়। এ এক যুগ, যেখানে ‘লাইক’ ভালোবাসার প্রতীক, ‘ভিউ’ সাফল্যের পরিমাপ— অথচ একটিবার চোখে চোখ রাখার সাহসও হারিয়ে ফেলেছে মানুষ।
মানবতা আজ এক নিঃশব্দ প্রশ্নে পরিণত হয়েছে— আমরা কি মানুষ থেকে যন্ত্রে রূপান্তরিত হচ্ছি, নাকি যন্ত্রের মধ্যে হারিয়ে ফেলছি মানুষকে? আমিত্বের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সহমর্মিতার বৃক্ষ, আর নৈতিকতার ছায়া ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতার অন্ধকারে। এই ডিজিটাল সভ্যতার স্রোতে আমাদের প্রয়োজন একটিমাত্র বিরতি— এক মুহূর্তের নীরবতা, যেখানে স্ক্রিন নয়, হৃদয় কথা বলবে; যেখানে মানুষ আবার মানুষকে চিনবে, মুখে নয়, মনে।
এই ডিজিটাল যুগে সমাজে যা ঘটছে:
১. এক ক্লিকেই মুছে যাওয়া মানুষ
আজকের পৃথিবী এক বিশাল ডিজিটাল আয়না— যেখানে মানুষ নিজের প্রতিবিম্বে বিভোর, কিন্তু অন্যের মুখ ভুলে গেছে। আমরা এমন এক সভ্যতার দরজায় দাঁড়িয়ে, যেখানে মানবিকতার মূল্য নির্ধারিত হয় মেগাবাইটে, আর আবেগের পরিমাপ হয় রিয়্যাকশন-ইমোজিতে।
একটা সময় ছিল, যখন একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো নিঃশব্দে বিনিময় হতো; এখন সেই চোখ পর্দায় স্থির। “আমরা” নামের সত্তা আজ ভেঙে টুকরো হয়েছে “আমি”-এর অহংকারে।
এই আত্মমগ্নতার স্রোত যেন এক বালুঘড়ির সমাজ তৈরি করেছে— যেখানে সময় বয়ে যায়, সম্পর্কের বালি ফুরিয়ে যায়, আর আমরা তাকিয়ে থাকি নিঃশব্দ স্ক্রিনে, যেখানে আলো আছে, কিন্তু উষ্ণতা নেই।
২. প্রযুক্তির সন্তান: ইনফরমেশন হাইওয়ের নবজাতক
এই যুগের শিশু জন্ম থেকেই সংযুক্ত পৃথিবীর নাগরিক। তাদের প্রথম কান্না এখন মোবাইল ক্যামেরার ফ্ল্যাশে বন্দি, প্রথম হাঁটাচলা হয় ভিডিও কন্টেন্টের অংশ, আর প্রথম হাসি প্রকাশিত হয় ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
তাদের জন্য পৃথিবী এখন ডাটা আর ডিভাইসের সমার্থক। তারা জানে “সিরি (Siri) ”-র উত্তরে হাসতে, কিন্তু চেনেনা প্রতিবেশীর নাম। কিন্তু তারা জানে “গুগল” কী বলে, কিন্তু জানে না দাদির গল্পের মানে কী ছিল।
তাদের যুক্তি নির্ভুল, কিন্তু হৃদয় নিস্তব্ধ। তারা উড়তে জানে, কিন্তু মাটির টান ভুলে গেছে। তাদের স্বপ্ন আছে, কিন্তু লক্ষ্য নেই। এ এক প্রজন্ম, যাদের কাছে “লাইক” হলো ভালোবাসা, “ভিউ” হলো সাফল্য, আর “ফলোয়ার” হলো বন্ধুত্বের পরিমাপ।
এই আত্মনির্ভর, কিন্তু আবেগশূন্য প্রজন্ম যেন ফুলের মতো ফোটে, কিন্তু সুবাস ছড়ায় না— কারণ প্রযুক্তি তাদের শিখিয়েছে গতি, কিন্তু শেখায়নি গন্তব্য।
ক্লিক করুন এবং পড়ুন: আমজনতার অধিকার বঞ্চনা —অধিকারের মাটি শুকিয়ে
গেলে উন্নয়নের ফসল ফলবে কেমন করে?
৩. একক পরিবার, একাকী আত্মা
যৌথ পরিবারের হাসির আওয়াজ এখন স্মৃতির আর্কাইভে জমা। আজকের সন্তান বড় হচ্ছে ডিজিটাল দুলাল হয়ে— মা-বাবা ব্যস্ত কর্মজীবনে, আর তাদের মানসিক বিকাশের শিক্ষক হয়ে উঠছে “ইউটিউব কিডস”।
যে পিতা একদিন গল্প বলতেন “হাতি কেন দাঁত রাখে”, আজ সেই পিতা সন্তানের কাছে পাঠান কেবল “ইমোজি স্মাইলি।” যে মা একদিন ঘুম পাড়াতেন ছড়া শুনিয়ে, আজ সেই মা ঘুম পাড়ানোর অ্যাপে খুঁজে নেন শান্তি।
একাকীত্বের এই পৃথিবীতে শিশুরা শিখছে, মানুষের সঙ্গে নয়, মেশিনের সঙ্গে কথা বলতে। বন্ধুত্ব মানে এখন ‘ফলোয়ার’, ভালোবাসা মানে ‘হার্ট রিঅ্যাকশন’।
এই শিশুরা বড় হচ্ছে এমন এক ভার্চুয়াল জগতে, যেখানে চোখে চোখ রাখার চেয়ে স্ক্রিনে চোখ রাখা নিরাপদ মনে হয়।
৪. ইলেকট্রিক লাভের যুগ: আবেগের অবক্ষয়
মনোবিজ্ঞানী ব্রোমেন যেভাবে বলেছেন— এই প্রজন্মের ভালোবাসা “ইলেকট্রিক লাভ”— উষ্ণ নয়, উত্তেজনাময়; স্থায়ী নয়, স্থিরতাহীন। দার্শনিক হোমি বাবার (Homi Baba) ভাষায়, এটি “হাইব্রিড জেনারেশন”— অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ভার্চুয়াল সত্তা।
তারা তথ্য বিশ্লেষণ জানে, কিন্তু অনুভবের ভাষা জানে না। তারা ক্লাউডে স্মৃতি রাখে, কিন্তু হৃদয়ে নয়। তারা আত্মহত্যা করে “লাইক” না পেয়ে, ভেঙে পড়ে ভার্চুয়াল প্রত্যাশার চাপে।
এ এক যুগ, যেখানে নোটিফিকেশনের শব্দে ভেঙে যায় স্বপ্নের পিক্সেল। ভালোবাসা মানে কন্টেন্ট, সম্পর্ক মানে কনট্রাক্ট। আর অনুভূতি— কেবল পোস্টের নিচে লেখা “Feeling Broken।”
৫. নৈতিকতার ধ্বস: আমিত্বের হাহাকার
আমিত্ব আজ ধর্ম, অহংকার আজ জাতীয় চরিত্র। সবাই নিজেকে আলাদা প্রমাণে ব্যস্ত, কিন্তু কেউ আলাদা হয়ে উঠতে পারছে না।
আমরা এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে মানুষ মানুষকে শ্রদ্ধা করতে জানে না। অন্যের সাফল্যে অভিনন্দন জানানো দূরে থাক, তার আলোয় নিজের প্রদীপ নেভাতে তৎপর সবাই।
মিথ্যা, প্রতারণা, কৃতঘ্নতা— এগুলো এখন সামাজিক সংস্কৃতির অংশ। সততা আজ নির্বুদ্ধিতা,
ধৈর্য আজ দুর্বলতা, আর মানবতা এখন একটি মীম মাত্র।
এই সমাজের মানুষরা কেবল নিজের প্রতিচ্ছবি তাড়া করছে— সেলফি তুলছে নিজেদের সঙ্গে,
কিন্তু ভুলে গেছে, কখনও কখনও অন্যের মুখেই দেখা যায় নিজের আসল চেহারা।
ক্লিক করুন এবং পড়ুন: মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, অশান্তি ও অধিকারহীনতার
সমাপ্তি হইবে কবে? —ধর্মের প্রদীপ নিভিলে জ্বলে বিভেদের অগ্নিশিখা
৬. মেধা বনাম ব্যবস্থা: উল্টো রাজনীতির রাজত্ব
বাংলাদেশে আজ দেখা যায় এক করুণ উল্টোচিত্র। যে ছাত্র একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়েছে, সে এখন সীমিত সুযোগে শিক্ষক। আর যে ছাত্র ক্লাসে নোটবুক খুলত না, সে আজ সরকারি কর্মকর্তা, নীতি নির্ধারক, কিংবা রাজনীতিক। —এ যেন মেধার কফিনে রাজনীতির হাতের ছোঁয়া। এ দেশে মেধা নয়, সম্পর্কই সাফল্যের মাপকাঠি। রাজনীতি হয়ে গেছে পুঁজিবাদের নতুন শাখা— যেখানে মতাদর্শ বিক্রি হয়, আর আদর্শ হয় নিঃস্ব।
মেধাবী শিক্ষক পড়ান, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন কাঁদের চেয়ে নিম্ন মেধার আমলা; আবার বুদ্ধিজীবী চিন্তা করেন, কিন্তু নীতি বানান অদক্ষ অর্ধ-শিক্ষিত রাজনীতিক। এভাবেই আমরা তৈরি করছি এক বিপরীত সভ্যতা, যেখানে বুদ্ধি নত, আর মূর্খতা মুকুট পরে।
৭. নীরব ঢেউ, গভীর স্রোত: সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা
এই উন্মাদ গতির পৃথিবীতে একটুখানি নীরবতা মানে ব্যর্থতা নয়— বরং মননশীলতার বিশ্রাম। “কখনও কখনও সাময়িক বিরতি সম্পর্ককে ভাঙে না, বরং আরও গভীর করে তোলে”— এই সত্য আজ আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে প্রাসঙ্গিক। ডিজিটাল যুগেও সম্পর্ক বাঁচতে পারে, যদি আমরা অহংকারকে লগ আউট করি। আমিত্বের দেয়াল ভেঙে যদি বোঝাপড়ার সেতু গড়ি। কারণ নীরবতা অনেক কথা বলে— যদি মন শোনার মতো প্রশান্ত থাকে।
ক্লিক করুন এবং পড়ুন: জীবন সমাচার: মানব অস্তিত্বের পরম রহস্য
করণীয়: হৃদয়ের মণিকোঠায় এক বিন্দু আলোর উদগীরণ
স্বপ্নবাজ, তবে টার্গেট-লেস এই প্রজন্মের মেধা সন্দেহাতীত। টার্গেট করলে চাঁদে গিয়ে বাড়ি বানাতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রথম সিঁড়ি ভাঙলেই টিকটক খুলে বসে, আর বলে, “আরও একটু ভাইরাল হই তারপর দেখি!” লক্ষ্যের দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার আগেই ‘লাইক’ আর ‘সাবস্ক্রাইব’ নামক ঘূর্ণাবর্তে তারা জড়িয়ে পড়ে। স্বপ্ন দেখা খারাপ নয়। কিন্তু সেই স্বপ্ন যদি হয় শুধু "স্টোরি রিচ" বা "রিলস রেডি", তাহলে সেটা স্বপ্ন না— সেটা ফিল্টার করা ফ্যান্টাসি। আর এই ফ্যান্টাসি থেকে এই প্রজ্ন্মকে বাস্তবে নামিয়ে আনা গেলে ধরণীর বুকে নব ইতিহাস রচিত হবে। এই প্রজন্ম যদি নিজের সুপ্ত শক্তি জাগিয়ে তোলে, তবে তারা শুধু নিজেদের নয়, গোটা জাতির ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। তবে সেটা করতে হলে, সবার আগে আমিত্বের অ্যাপ থেকে লোগআউট করতে হবে। মানুষ হতে হবে— মেশিন নয়। এদেশের মানুষ সব পারে— যদি একবার ইচ্ছা করে। তাই আসুন, আরেকবার মানুষ হই— ফেসবুক ছেড়ে, মুখোমুখি হই।
এই প্রজন্ম জন্ম থেকেই সমাজেকে বুঝার জন্য পরিবেশ বা প্রতিবেশ কোনোটাই পায় না। এক সময় ছোট ছেলে মেয়েদের শৈশব ও কৈশোর কাটতো দাদা-দাদী বা নানা-নানী বা ঠাকুরদা-ঠাকুরদি’ির মুখে গল্প শুনে। আর এখন, সামান্য আয় বাড়াতে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার হয়ে গেছে আর সন্তানের সুখ স্বচ্ছন্দের জন্য একটু ভালো চলার মরিচিতাকায় পরিবারে আজ ডাবল চাকরি। আর ভালোবাসার এই সন্তানেরেই বড় হচ্ছে চাকর-আয়া-বুয়ার কোলে, একাকীত্বের নিশব্দ জগতে মোবাইলের ফ্রেমে শৈশব আর কৈশোর বন্দি হয়ে যাচ্ছে টাচ স্ক্রিনে। হাইব্রিড একটা জেনেরেশন ‘আইপ্যাড কিড’ তৈরি হচ্ছে, বিচার অবস্থান সবই তাদের ভার্চুয়াল রিয়্যাকশন, হৃদয়ের আবেগ- ভালোবাসা তাদের কাছে কোনো আকর্ষণ নয়। তাই সহজেই এন্টি-সোশাল হয়ে উটছে, মাদক, কিশোর গ্যাং, আত্মহননের প্রবণতা— এইসব ঘটনা যেনে তাদের জীবনে প্রবেশ করছে অহরব বিনা অনুমতিতে।
ক্লিক করুন এবং পড়ুন: একটি কাব্যিক সম্পাদকীয় — শান্তির খোঁজে মানুষের অনন্ত যাত্রা: আলো-অন্ধকারের গল্প
আমরা যদি সত্যিই চাই এই প্রজন্মকে আলোর দিকে নিতে, তাহলে প্রথমেই দরকার বোঝার চেষ্টা, বিচার নয়। আবেগিক ভারসাম্য তৈরি করার জন্য শুধু পড়াশোনা নয়, দরকার জীবন শিক্ষা। তাদেরকে স্বার্থপরতার সেলফি কালচার তেকে বের করে আনতে হবে। ইমোজি ইনবক্স নয় সত্যিকারের জগতে করতে হবে দায়িত্বশীল! এ জন্য সন্তানকে সময় দিতে হবে। আবার ফিরে যেতে হবে যৌথ পরিবারে গ্রামীন সংস্কৃতিতে। তাদেরকে কিভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়, সেটা আগে শিখতে হবে। তারপর শেখানো যাবে। শুধু “গোল্ডেন এ প্লাস” না, দরকার গোল্ডেন মানবিকতা। শুধু গুগল সার্চ না, দরকার হৃদয়ের সার্চ ইঞ্জিন। শুধু আইডল না, দরকার আইডিয়াল!
১. মানবতার প্রদীপ আবার জ্বালাতে হবে
অন্ধকারকে দূর করার জন্য শত আলো প্রয়োজন হয় না— একটি প্রদীপই যথেষ্ট। আর সেই প্রদীপের নাম মানবতা। আমাদের সন্তানদের হাতে কেবল স্মার্টফোন নয়, তাদের হাতে দিতে হবে মূল্যবোধের বই, সহানুভূতির পাঠ। শিক্ষা কেবল সার্টিফিকেট নয়, মানুষ হওয়ার চর্চা হতে হবে। গোল্ডেন এ-প্লাস নয়, প্রয়োজন গোল্ডেন মানবিকতা। আমাদের সমাজে এখন সবচেয়ে জরুরি “ইমোশনাল কারিকুলাম”— যেখানে শেখানো হবে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়, কিভাবে শ্রদ্ধা দেখাতে হয়, আর কিভাবে ভালোবাসা যায় শব্দের অতিরিক্তে।
২. মানুষ হয়ে ওঠা— এটাই একমাত্র বিপ্লব
আজকের সভ্যতার বিপর্যয় প্রযুক্তির নয়, হৃদয়ের ক্ষয়। আমরা তথ্যের সাগরে ভাসছি, কিন্তু অনুভূতির তীরে পৌঁছাতে পারছি না। আমরা জ্ঞানে বড় হচ্ছি, কিন্তু মানবিকতায় ছোট হয়ে যাচ্ছি। মানুষ হয়ে ওঠা এখন একমাত্র বিপ্লব— একটি বিপ্লব, যেখানে শত্রু হলো অহংকার, আর অস্ত্র হলো সহমর্মিতা। যেদিন আমরা আবার শিখব চোখের জল মুছতে, যেদিন প্রতিবেশীর দুঃখে থেমে যাব, সেদিনই সভ্যতা পুনর্জন্ম নেবে। আমিত্বের আগুন নিভিয়ে, মানবতার আলো জ্বালানোই আজকের একমাত্র মুক্তি।
৩. সমাপ্তি: এক বিন্দু আলো, নীরব ঢেউয়ের আহ্বান
ডিজিটাল আলোয় আমরা ঝলমল করছি, কিন্তু সেই আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মুখ। সময় এসেছে সেই মুখগুলিকে আবার চিনে নেওয়ার, ভালোবাসার ভাষা শেখার, আর নীরব ঢেউয়ের গভীর স্রোতে কান পাতার। কারণ, নীরব ঢেউ-ই বলে— গভীর স্রোত এখনো বেঁচে আছে, শুধু আমরা শুনতে ভুলে গেছি।
৪. বি:দ্র: এই সম্পাদকীয় কেবল এক সামাজিক বিশ্লেষণ নয়—
এ এক দার্শনিক প্রতিফলন। যেখানে প্রযুক্তি একদিকে সভ্যতার অর্জন, অন্যদিকে মানবতার হারানো অধ্যায়। এখানে আধুনিকতা ও মনুষ্যত্বের সংঘর্ষ প্রতিফলিত হয়েছে কাব্যিক উপমা ও রূপকে। প্রবন্ধটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়— প্রগতি তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তার কেন্দ্রে থাকে মানুষ, না যে মেশিন।
#ডিজিটাল_অবক্ষয় #আমিত্বের_যুগ #মানবতার_সংকট #বাংলা_সম্পাদকীয়
✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: