odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Monday, 3rd November 2025, ৩rd November ২০২৫
জাতির শিক্ষক যখন আন্দোলনে—এই নীরব প্রতিবাদ এক পদ্ধতিগত বৈষম্যের জ্বলন্ত প্রমাণ। জাতীয়করণ ও মর্যাদার দাবিতে রাস্তায় বসে আছেন হাজারো শিক্ষক

রাস্তায় শিক্ষক কেন? — অবহেলিত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার মর্যাদার লড়াই

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৩ November ২০২৫ ০৪:৫৫

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৩ November ২০২৫ ০৪:৫৫

সম্পাদকীয়

ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কুয়াশা ঢাকা এক ভোর। মলিন শীতের কাপে চুমুক দিয়ে কিছু ক্লান্ত মুখ—চোখে অবসাদ, কিন্তু তাতে মিশে আছে দৃঢ়তা। তাঁরা কেউ রাজনৈতিক কর্মী নন, নন কোনো আন্দোলন পেশার মানুষ। তাঁরা জাতির শিশুমন গড়ার কারিগর—স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা।  ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনের রাজপথে দিনের পর দিন অবস্থান করছেন একদল শিক্ষক—তাদের হাতে লেখা ব্যানারে লেখা, “আমরা শিক্ষক, ভিক্ষুক নই; জাতীয়করণ চাই”। তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী নন, নন কোনো পেশাজীবী সংগঠনের নেতা—এরা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকবৃন্দ। তাদের আন্দোলন শুধু বেতন বা সুবিধার জন্য নয়; এটি একটি শিক্ষাধারার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। রাজপথে তাদের অবস্থান এখন প্রতিরোধের প্রতীক, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন শত শত শিক্ষক। হাতে ব্যানার—“আমরা শিক্ষক, ভিক্ষুক নই; জাতীয়করণ চাই।” এই দৃশ্য কেবল একটি প্রতিবাদের নয়, এটি রাষ্ট্রের আত্মসমালোচনার মুহূর্ত। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষারই অংশ। কিন্তু প্রশাসনিক দ্বৈততা, রাজনৈতিক অনাগ্রহ এবং নীতিগত উদাসীনতায় তারা আজ রাষ্ট্রের অদৃশ্য নাগরিক।

এক প্রান্তিক শিক্ষাধারার চিত্র

বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা শত বছরের ঐতিহ্য বহন করে। এই ধারায় ইবতেদায়ি স্তর (১ম থেকে ৫ম শ্রেণি) হচ্ছে শিক্ষার মূলভিত্তি, যেখানে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে গঠিত হয় শিশুদের মানবিক মূল্যবোধ। কিন্তু এই স্তরের মধ্যেই দুটি পৃথক ধারা—সংযুক্ত ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা। প্রথমটি দাখিল মাদরাসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এমপিওভুক্ত; দ্বিতীয়টি—স্বতন্ত্র—রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়াই টিকে আছে প্রায় ৪০ বছর ধরে।  

একই পাঠ্যক্রম, একই পরিশ্রম, কিন্তু মর্যাদা ও বেতনের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। সংযুক্ত মাদরাসার শিক্ষকরা যেখানে মাসে ১৫,০০০ টাকার বেশি পান, সেখানে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক পান মাত্র ২,৩০০ টাকা—অনেকে বিনা বেতনে পড়ান। এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়; এটি রাষ্ট্রের নৈতিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

একটি ব্যবস্থাগত বৈষম্য

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসে পান ৩০,০০০ টাকা, সংযুক্ত মাদরাসার শিক্ষক ১৫,০০০ টাকারও বেশি। অথচ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি শিক্ষক পান মাত্র ২,৩০০ টাকা, অনেকে বিনা বেতনে। একই স্তরে কাজ করেও এমন বৈষম্য একটি নৈতিক ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়। অপরদিকে কেই যেনো তাদের দায়িত্ব নিতে নারাজ। কেননা প্রাথমিক শিক্ষা পড়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে, আর মাদরাসা শিক্ষা কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে। এই দ্বন্দ্বেই স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা পরিণত হয়েছে এক “অদৃশ্য প্রতিষ্ঠান”-এ। ফাইল ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়—এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে, অথচ মাঠে শিক্ষক হাঁটেন ক্ষুধার পথে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভাবে, “এটা প্রাথমিকের বিষয়”; প্রাথমিক মন্ত্রণালয় বলে, “এটা মাদরাসার আওতায়।” ফলে শিক্ষা থেকে সম্মান পর্যন্ত হারিয়ে গেছে এক অদ্ভুত প্রশাসনিক গোলকধাঁধায়।

নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতা

দশকের পর দশক ধরে এই শিক্ষকরা রাজপথে বসে আছেন। সরকারের ঘোষণাও এসেছে—১,৫১৯টি মাদরাসা এমপিওভুক্ত করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হাজারো ফাইল এখনো মন্ত্রণালয়ের টেবিলে। “প্রাথমিক না মাদরাসা”—এই প্রশাসনিক দোদুল্যমানতায় হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো শিক্ষকের জীবন।

সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ বলছে, “প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে।” কিন্তু যারা সেই শিক্ষার ধারক, তারা যদি মানবিক ও আর্থিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে এটি শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়—এটি সাংবিধানিক লঙ্ঘন।

রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা ও ন্যায়ের প্রশ্ন

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়—স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো ধাপে ধাপে জাতীয়করণ করা হবে। ১,৫১৯টি মাদরাসা এমপিওভুক্তির অনুমোদনও পেয়েছে। কিন্তু এর বাইরে থাকা প্রায় ৫,০০০ মাদরাসা ও ২৫,০০০ শিক্ষক এখনও অপেক্ষায়—প্রজ্ঞাপন আসেনি, প্রতিশ্রুতি ঝুলে আছে কাগজের স্তূপে।  বাংলাদেশের সংবিধানের  ১৭ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে—প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে।কিন্তু একদল শিক্ষক, যারা সেই প্রাথমিক শিক্ষারই ধারক, তারা যদি রাষ্ট্রের সুযোগ ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন, তবে এটি শুধু নীতিগত নয়—সাংবিধানিক পরিপন্থী বৈষম্য।

শিক্ষকদের দাবিগুলো যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত:

  1. সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার জাতীয়করণ দ্রুত বাস্তবায়ন।
  2. এমপিওভুক্তির জন্য ঝুলে থাকা ফাইলের দ্রুত অনুমোদন।
  3. অনুদানবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য জরুরি সহায়তা ও প্রাক-প্রাথমিক পদ সৃষ্টি।
  4. আলাদা ইবতেদায়ি অধিদপ্তর গঠন করে প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা।

এই দাবিগুলো কোনো বিলাসিতা নয়—এগুলো ন্যায্য অধিকার। আর এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করায় রাষ্ট্রের নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। আজ যখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মাসে ৩০,০০০ টাকা বেতন পান, তখন ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক ২,৩০০ টাকায় সংসার চালাতে বাধ্য। এটি কেবল বেতনের প্রশ্ন নয়—এটি মর্যাদার প্রশ্ন। জাতির মেরুদণ্ড বলা হয় যাদের, সেই শিক্ষকদের আজ রাজপথে বসতে হয়েছে। এ এক গভীর নৈতিক লজ্জা—রাষ্ট্রের প্রতি, সমাজের প্রতি, আমাদের সবার প্রতি। শিক্ষক জাতির বিবেক। তাদের অবমাননা মানে জাতির আত্মাকে আঘাত করা। আজ যদি শিক্ষক রাজপথে বসে মর্যাদা দাবি করেন, তাহলে রাষ্ট্রের উন্নয়নের সব পরিসংখ্যান অর্থহীন।

ন্যায়বিচারের দাবি—“Don’t Touch It” থেকে “Let Them Rise”:

শিক্ষকদের প্রেসক্লাবের রাজপথে আন্দোলন যেন এক আহ্বান—‘Don’t Touch It’ নয়, বরং ‘Touch Their Rights, Touch Their Pain’

—এটাই সময়ের দাবি।

মানবাধিকারের এই প্রশ্ন কেবল মাদ্রাসা শিক্ষকের নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অন্তর্গত ন্যায়ের সূক্ষ্মতম পরিক্ষা। যে রাষ্ট্র জাতির বিবেক গঠনের ভার যাঁদের হাতে তুলে দেয়, তারা যদি আজও পড়ে থাকে বেতনহীন এক জীবনে, তবে উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি নিছক এক মুখোশ মাত্র।

ছুঁয়ে দিতে চাইতাঁদের আর্তনাদ, তাঁদের প্রাপ্যতা: শিক্ষকদের আন্দোরনে বের হয়ে এসছে এক নির্মম সত্যের বিবরণ—যেখানে শিক্ষকেরা সমাজগঠনের কারিগর হয়ে থেকেও সবচেয়ে অবহেলিত এক বৃত্তে আবদ্ধ। তাঁদের জীবনের প্রতিটি দিন এক পরীক্ষার, এক প্রতিকূলতার, যেখানে আশার আলো এক বিন্দু রোদ্দুর হয়ে দেখা দেয়; আবার মুছে যায় বৃষ্টির ধোঁয়ায়। এই উপস্থাপনাটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং এক আত্মা-ছোঁয়া ব্যঞ্জনা—“Don’t Touch It” যেন হয়ে ওঠে “Touch Their Soul, Touch Their Rights”।

শিক্ষকদের দাবি ও সমাধান

১. সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার জাতীয়করণ দ্রুত বাস্তবায়ন।
২. এমপিওভুক্তির ফাইল দ্রুত অনুমোদন।
৩. অনুদানবিহীন মাদরাসার জন্য জরুরি সহায়তা।
৪. প্রাথমিক স্তরের সঙ্গে সমমর্যাদার বেতন কাঠামো।
৫. আলাদা ইবতেদায়ি অধিদপ্তর গঠন।

এই দাবিগুলো কোনো বিলাসিতা নয়—এগুলো রাষ্ট্রের ন্যায্য দায়বদ্ধতা।

আমাদের অবস্থান

এই সম্পাদকীয় বোর্ডের স্পষ্ট মত হলো—
রাষ্ট্রের দায়িত্ব অবিলম্বে এই বৈষম্যের অবসান ঘটানো।
ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো জাতীয় শিক্ষার অংশ; তাদের শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নন।
জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, এমপিও প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন—এগুলো এখনই প্রয়োজন।

শেষ কথা

ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনে সেই শীতল ভোরে যখন শিক্ষকরা চুপচাপ বসে আছেন, তারা কোনো রণহুঙ্কার দিচ্ছেন না। তারা নীরব, কিন্তু তাদের প্রতিবাদ প্রখর। তারা লড়ছেন নিজেদের মর্যাদার জন্য, এবং দেশের শিক্ষার ভবিষ্যতের জন্য। রাষ্ট্র যদি “সবার জন্য শিক্ষা”র অঙ্গীকারে সত্যিই বিশ্বাস করে, তবে এখনই সময় এই বৈষম্যের অবসান ঘটানোর। কারণ, এক জাতি তখনই পতিত হয়, যখন সে নিজের শিক্ষকের ক্ষুধাকে উপেক্ষা করে। আমরা যদি এমন একটি সমাজ চাই যেখানে নৈতিকতার শিক্ষক ক্ষুধার্ত নয়, যেখানে শিক্ষা মর্যাদার প্রতীক, তবে আজই এই বৈষম্য বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় একদিন ইতিহাসে লেখা থাকবে—“তারা শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু স্বীকৃতি পাননি।”

✍️অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

স্বতন্ত্র ইবতাদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষা ও শিক্ষকদের বঞ্চসা সম্পর্কে জানতে পাঠ করুন বিশেষ নিবন্ধ “শিক্ষকরাই কেন রাস্তায়? — স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার অধিকারহারা সৈনিকদের দীর্ঘ সংগ্রাম”

#স্বতন্ত্রইবতেদায়ী  #শিক্ষকের_অধিকার  #মাদ্রাসা_জাতীয়করণ  #শিক্ষাখাতে_বৈষম্য  #শিক্ষকরাই_মেরুদণ্ড  #আমরা_শিক্ষক_ভিক্ষুক_নই  #ন্যায়বিচার_চাই  #জাতীয়_শিক্ষা_নীতিমালা  #প্রাথমিক_শিক্ষা_বঞ্চনা  #শিক্ষা_হোক_সমতার



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: