odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Monday, 3rd November 2025, ৩rd November ২০২৫
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকরা আজ রাজপথে; তাদের লড়াই বেতনের নয়, মর্যাদার—মানবিক রাষ্ট্রের প্রতি এক নীরব প্রশ্ন।

যে হাতে অক্ষর শেখানো হয়, সে হাতই আজ রাজপথে ব্যানার ধরে—ন্যায়ের অপেক্ষায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের দীর্ঘ সংগ্রাম এবং নিরব অশ্রু

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৩ November ২০২৫ ০৫:১৬

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৩ November ২০২৫ ০৫:১৬

—বিশেষ নিবন্ধ

ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনে ঠাণ্ডা ভোরে হাতে ব্যানার—“আমরা শিক্ষক, ভিক্ষুক নই; জাতীয়করণ চাই”– এই লড়াইতে দাঁড়িয়ে আছে দেশের এক অবহেলিত শিক্ষাধারা: স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকরা। বৈষম্য ও অবহেলার বিরুদ্ধে তাদের দাবি স্পষ্ট: প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তাদের সম্মান ও অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।

আজ ভোরের মলিন আলোয় দেখা যায় একটি দৃশ্য — ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, কাপড়ে চুমুক দিচ্ছে এক–একজন শিক্ষক। ক্লান্ত চোখে ভর করে অভিজ্ঞতার গুচ্ছ, হাতে হালকা ব্যানার—শব্দহীন নয়, কিন্তু বিমর্ষ এক ধীরসংকোচ। তারা কোনো রাজনৈতিক র‍্যালির আগাম প্রস্তুতচিহ্ন নয়। তারা এমন মানুষ, যাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয় শিশুর প্রথম অক্ষর, মানবিক রূপদান, নৈতিকতা শিক্ষা। কিন্তু আজ তারা নিজেই রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন তুলছে—“আমরা শিক্ষক, ভিক্ষুক নই।”

এই শিক্ষকরা এগিয়ে আসছেন এক এমন অভিযানে, যা শুধু বেতনের নয় বরং মর্যাদার, সুষ্ঠু প্রশাসনের, সম অধিকার ও সম্মানের লড়াই। তারা হচ্ছেন বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডভুক্ত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোর (১ম–৫ম শ্রেণি) শিক্ষকবৃন্দ—যে ধারা রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নীতিমালায় দীর্ঘদিন “উপেক্ষিত” হয়ে আসছে।

আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা: ঐতিহ্যের ধারক ও নৈতিকতার আলোতে শিক্ষার সূচনা

বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক। এই শিক্ষা শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান নয়—এটি নৈতিকতার, আদর্শের, আত্মার শিক্ষা। ইবতেদায়ি স্তর সেই শিকড়, যেখানে শিশু প্রথমবার শেখে “বিসমিল্লাহ”, শেখে অক্ষর, শেখে মানবতা। কিন্তু এই শিকড় আজ শুকিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের উদাসীনতায়, প্রশাসনের জটিলতায়, নীতিনির্ধারকদের নীরবতায়। বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা পাঁচ স্তরে বিভক্ত—ইবতেদায়ি (প্রাথমিক, শ্রেণি ০১-০৫), দাখিল (মাধ্যমিক, শ্রেণি ০৬-১০), আলিম (উচ্চ- মাধ্যমিক, শ্রেণি ১১-১২),, ফাজিল (স্নাতক, ০৩-০৪ বছর), ও কামিল (স্নাতকোত্তর, ১ থেকে ২ বছর)। এর মধ্যে ইবতেদায়ি স্তর (১ম থেকে ৫ম শ্রেণি) হলো ভিত্তি, যেখানে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে শিশুদের মানবিক ও নৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা হয়। এই ইবতেদায়ি স্তর আবার দুটি ভাগে বিভক্ত:

দুটি ইবতেদায়ি ধারা—

  • সংযুক্ত ইবতেদায়ি মাদরাসা: দাখিল মাদরাসার সঙ্গে যুক্ত, তাই সরকারিভাবে এমপিওভুক্ত।
  • স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা: শুধুমাত্র প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রদান করে, কিন্তু প্রশাসনিকভাবে উপেক্ষিত ও অদৃশ্য।

উপরের দুই ধরণের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকবৃন্দের সুযোগ-সুবিধায় আকাশ-পাতাল তফাৎ।  একই শিশু, একই পাঠ্যক্রম, একই শিক্ষকতা—কিন্তু মর্যাদা আকাশ-পাতাল ভিন্ন।

মূলভিত্তার সংকট : বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য বহন করে — শিক্ষার সঙ্গে জীবনের নৈতিক রূপদান, ধর্মীয় ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়। এখানে ইবতেদায়ী স্তর অর্থবহ: ১ম থেকে ৫ম শ্রেণিতে শিশু প্রথম অক্ষর শেখে, মান–মর্যাদা বুঝতে শুরু করে।  তবে এই স্তর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়: সংযুক্ত ইবতেদায়ী মাদরাসা (যেগুলো দাখিল/আলিম মাদরাসার সঙ্গে যুক্ত) এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা (শুধু প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করে)। এই দুটো ধারা এক রকমের কাজ করে, কিন্তু মর্যাদা ও সুযোগ করে দেওয়া হয় একরকমভাবে নয়। সংযুক্ত ইবতেদায়ীর শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হয়ে সরকারি বেতন ও সুবিধা পান; কিন্তু স্বতন্ত্র ইবতেদায়ীর শিক্ষকরা—বা অনেক ক্ষেত্রে বিনা বেতনে পড়ান। এটি এক মাত্র আর্থিক নয়, নৈতিক ক্ষেত্রে এক গভীর বৈষম্যের প্রতিফলন।

বঞ্চনার ইতিহাস: ১৯৮০-এর দশকের আগে পর্যন্ত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলোর পরিচালনা ছিল সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে, কোনো সরকারি অনুদান, নীতিমালা বা কারিগরি সহায়তা ছাড়াই। এরপরে ১৯৮৬ সাল হতে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কিছু শর্তসাপেক্ষে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা পরিচালনার অনুমতি প্রদান শুরু করে। কালক্রমে ১৯৯৪ সালে নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণকারী ১,৫১৯টি মাদরাসাকে সীমিত আর্থিক অনুদান প্রদান শুরু হয়—প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক প্রতি ৫০০ টাকা করে। অর্থ্যাৎ ১৯৯৪ সালে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী কিছু মাদরাসা আন্তরিকভাবে অনুদান পেতে শুরু করে, শুধু হাজার টাকার পরিমাণে। তার পরেও বছর শেষে বছর তাদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটে নি — অনুদান বৃদ্ধি পায় ধীরে ধীরে, অথচ তুলনায় সাধারণ প্রাথমিক ও সংযুক্ত মাদরাসার শিক্ষকরা অনেক দূরে যায়। এই ইতিহাস শুধু সংখ্যার খেলাই নয়; এটি এক দীর্ঘ অপমানের রেকর্ড। একজন শিক্ষক যিনি শিশুর প্রথম অক্ষর শেখায়, তার মাসিক আয় হয় মাত্র দুই হাজার টাকারও কম—এটি শুধু বাবা–মায়ের ঘুম ভাঙানোর কারণ নয়, এটি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।এরপরে ২০১৮ সালে সরকার “মাদ্রাসা শিক্ষা নীতিমালা-২০১৮” প্রণয়ন করে, যেখানে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপন, পরিচালনা, পাঠ্যক্রম, শিক্ষক নিয়োগ ও বেতন কাঠামো সম্পর্কে প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু এমপিওভুক্তি বন্ধ থাকে।

বৈষম্যের টেবিল: একই দেশ, একই শিক্ষাব্যবস্থা, প্রায় একই পাঠক্রম, অথচ শিক্ষকরা পেলেন একরকম মর্যাদা না। নিচে কিছু তুলনায় দেওয়া হলো (আনুমানিক)։

  • সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক: মাসিক বেতন/ভাতা ২৫,০০০–৩০,০০০ টাকার মধ্যে।
  • সংযুক্ত ইবতেদায়ীর শিক্ষক (এমপিওভুক্ত): প্রায় ১৫,০০০+ টাকা।
  • স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী (অনুদানপ্রাপ্ত): ২,৩০০–২,৫০০ টাকা।
  • স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী (অনুদানবিহীন): ০ টাকা

এই চিত্র শুধু আর্থিক ভাঙন নয়—এটি সেই রাষ্ট্রীয় ঘোষণা “সুযোগের সমতা”র পরিপন্থী। নিচের টেবিলটি বেতন ভাতাদির অবস্থা বুঝতে সহায়তা করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বার্তা

শিক্ষকদের ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (IER)-এর মাধ্যমে “স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার বর্তমান পরিস্থিতি: একটি সমীক্ষা” শীর্ষক গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণায় উঠে আসে এক করুণ বাস্তবতা—

  • ৬৮.২% মাদরাসায় একজনও প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই।
  • ৭৯.১% প্রতিষ্ঠানে সীমানা প্রাচীর নেই।
  • ৪৯.১% টিনের ঘরে পাঠদান হয়।
  • ৭৫% শিক্ষক কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পাননি।
  • অধিকাংশ শিক্ষক নামমাত্র অনুদানেও বেতনবিহীনভাবে কাজ করছেন।

গবেষণাটি সরকারের জন্য নীতিগত সমাধানের রূপরেখা তৈরি করে দেয়, কিন্তু তার বাস্তবায়ন আজও অনিশ্চিত। এ্ি গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশসমূহ এমন কিছু নীতিকাঠামোর দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেগুলোর আলোকে স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোর ভবিষ্যৎ রচনার এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে পারে। এই প্রাপ্তি ব্যবহারযোগ্য হতে পারে—স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের প্রশ্নে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণে; সেই সঙ্গে, ২০১৮ সালের “স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা স্থাপন, স্বীকৃতি, পরিচালনা, জনবল কাঠামো ও বেতন-ভাতা/অনুদান বিষয়ক নীতিমালা”-এর আলোকে শিক্ষকগণের ন্যায্য গ্রেডভিত্তিক বেতন-ভাতা নিশ্চিতকরণে। সুপারিশগুলো আরও নির্দেশ করে, কীভাবে অনুদানপ্রাপ্ত মাদ্রাসার সংখ্যা ও অনুদানের পরিমাণ বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি করা যেতে পারে; কীভাবে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তাদের শিক্ষাজীবনকে টিকিয়ে রাখা যায়। সর্বোপরি, এই গবেষণা অনুরোধ রাখে—স্বতন্ত্র মাদ্রাসাগুলোকে বোর্ড কোডভুক্ত করে একটি সমন্বিত, সম্মানজনক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করার, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় ন্যায্যতাও হবে একসূত্রে গাঁথা।

প্রশাসনিক গোলকধাঁধা: একদিকে রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় (যে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্বে) — আরেক দিকে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর (যে মাদরাসা শিক্ষা দেখ after করে)। এই দ্বৈত দায়িত্বের কারণে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলো কার্যত প্রশাসনিক ‘অদৃশ্যতা’র মধ্যে পড়ে গেছে। মন্ত্রণালয় এক বলে “প্রাথমিকের বিষয়”, অন্য বলে “মাদ্রাসার বিষয়”। ফলে হাজারো ফাইল ঘোরে ঘোরে মিলন করে না বাস্তবতার সঙ্গে। এই জটিলতা শিক্ষকদের জন্য অভিযানের নয়, সংশোধনের জায়গা।

সামাজিক বঞ্চনার প্রতিচ্ছবি: “Don’t Touch It” এর অন্তরালে উপেক্ষিত স্বতন্ত্র ইবতাদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক সমাজ!  মৌলিক চাহিদায় উপেক্ষিত মেধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে, যখন জাতি স্বপ্ন দেখে উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তির, তখনও এক শ্রেণির মানুষ অন্ধকারে—আলো থেকে বহু দূরে। মাদ্রাসা শিক্ষকদের এক বড় অংশ, বিশেষ করে স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা, বেতনহীন, মর্যাদাহীন, এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। যেন এক রৌদ্রঝলমল দিনে, গাছের ছায়াতেও যারা দাঁড়ায়, তাদের ভাগ্যে আসে না শীতলতা।

পরিসংখ্যানের ব্যঞ্জনা, সংখ্যার ভাষায় না বলা কষ্ট: একইস্তরের অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যকার বেতনির তুলনা করলে স্বতন্ত্র েইবতাদায়ীল প্রতি যে অবহেলা, তা বুঝা যাবে।  তুলনামূলক বেতন কাঠামো—৪,৯৫০ টাকা বনাম ১৯,৩০০ টাকার সরকারি কাঠামো। এই সংখ্যাগুলো কেবল অর্থের মানদণ্ড নয়, বরং তা সমাজের শ্রেণিবিন্যাস এবং রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের প্রতিচ্ছবি। একজন শিক্ষক যিনি আলোকিত করতে চান জাতির ভবিষ্যৎকে, তিনি নিজেই যেন নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাওয়া এক নীরব যোদ্ধা। তিনি পুঁথি পড়ান, কিন্তু সন্তানকে পাঠাতে পারেন না স্কুলে। তিনি দ্বীনের কথা শেখান, অথচ নিজে ভোগেন জীবনের দুঃখসাগরে।

বাস্তবতার নির্মম ভাষ্য—বেতনহীন শিক্ষকতা- এ এক করুণ বাস্তবতা, যেখানে বেতন নির্ভর করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কত টাকা আদায় করতে পারে তার ওপর। করোনাকালে অনেক অভিভাবক সন্তানকে স্কুলে না পাঠানোয় আয় কমে যায়, শিক্ষকরা পান না বেতন।
কেউ কেউ পেশা বদলেছেন, কেউ বা মাসের পর মাস কাজ করছেন বিনা পারিশ্রমিকে—এ যেন জীবনের এক “Don’t Touch” ক্লেদাক্ত অধ্যায়, যেখানে ছুঁয়ে দেখলেই বেরিয়ে আসে অবহেলা, ব্যথা, ও লজ্জার ঘ্রাণ।

অদৃশ্য বৈষম্যের বলয়: একদিকে রয়েছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক, যাঁরা নিয়মিত বেতন পান, অন্যদিকে রয়েছে অগণিত নন-এমপিও ও স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক, যাঁদের কাছে ‘বেতন’ এক কল্পিত শব্দমাত্র। তাঁদের জন্য নেই নিয়মানুবর্তীতা, নেই সামাজিক মর্যাদা, নেই আর্থিক নিরাপত্তা। এই বৈষম্য এক অব্যক্ত আর্তনাদ—যা বেজে ওঠে প্রতিদিন ফজরের আজানে, আবার নিভে যায় বিদ্যালয়ের শেষ ঘণ্টায়।

মনুষ্য লড়াই - রাস্তায় শিক্ষকরা : ঢাকার প্রেসক্লাব ঘিরে দুপুরের আলো একটু নরম হয়ে আসে, তখন এক সারি শিক্ষক দাঁড়িয়ে আছে। ব্যানারে লেখা “আমরা শিক্ষক, ভিক্ষুক নই; জাতীয়করণ চাই”। তাদের চোখে ঘুম নেই, তাদের কণ্ঠে গাড়বড় শব্দ নেই—কিন্তু আছে অবিচল দৃঢ়তা। এক শিক্ষক বলেন, “আমি ত্রিশ বছর ধরে কোরআন ও বাংলা পড়িয়েছি … কিন্তু আজ নিজের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারিনি।” আরেক শিক্ষিকা হেসে জানান, “আমরা দেশের মেরুদণ্ড, অথচ ভাঙা পায়ে এই ব্যানার হাতে নিতে হল।” এরা শুধু দাবিতে নয়, আত্মসম্মান বাঁচাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে।

নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও হয়রানি: শিক্ষকদের দাবির পেছনে একটি বড় প্রশ্ন—কাদের জন্য? এই শিক্ষক যারা প্রান্তিক অঞ্চলে, গ্রামে, শহরের আপেক্ষিক অপ্রতিরোধ্য স্থানে শিশুদের হাতে প্রথম কলম তুলে দেন। তাদেরকে স্তরে স্তরে বঞ্চিত করা মানে শুধু এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়—এক প্রজন্মের নৈতিক ও মানবিক গঠনকে হেনস্থা করা। 

দাবি ও সমাধানের পথ

এই লড়াই রীতিতে নয়, নৈতিক ভিত্তিতে। তাদের দাবি রূপরেখা নিম্নরূপ:

  • সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার দ্রুত জাতীয়করণ।
  • এমপিওভুক্তির ফাইল দ্রুত অনুমোদন ও প্রজ্ঞাপন।
  • সমমর্যাদার বেতন কাঠামো চালু করা।
  • শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন।
  • প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপবৃত্তি চালু করা।

এই দাবিগুলো বিলাসিতা নয়—এগুলো শিক্ষা ব্যবস্থার ন্যায্যতা ও জাতির দায়িত্বের অংশ।

রাষ্ট্রীয় নৈতিক চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশের সংবিধান (অনুচ্ছেদ ১৯) ঘোষণা করেছে—“রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করবে।” এবং অনুচ্ছেদ ১৭ এ বলা আছে—“প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে হবে।” কিন্তু বাস্তবে সেই নীতি কতটা রূপ নিয়েছে? যদি শিক্ষকরা সম্মান, বেতন, নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত থাকেন—তাহলে শিক্ষার মৌলিক ভিত্তিই দোলাচলে পড়ে। এক শিক্ষক আজ রাজপথে দাঁড়িয়ে—এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত অসুবিধার নয়, জাতীয় নৈতিকতার পরীক্ষা।

পরিশেষে এক নতুন অধ্যায়ের আহ্বান: যখন দেশ বিশ্বের দরবারে বলতে চায় “সবার জন্য শিক্ষা”, তখন আমরা কি সত্যিই সেই মূল্যবোধে বিশ্বাস রাখি? যদি এমন হয়, তাহলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নীরব সৈনিকদের কথা ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাঁদেরকে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়—এটা আমাদের কোনো গৌরবের নয়, লজ্জার চিত্র। এই লড়াই যেন এক আলোর প্রদীপ হয়ে ওঠে—এক দুয়ার যা এখনো বন্ধ রয়েছে। বন্ধ দরজা যদি খোলা হয়, তাহলে শুধুই একটি শিক্ষক নয়—একটি শিক্ষাধারা, এক একটি শিশুর প্রথম অক্ষর, তার অন্তরে জাগ্রত নৈতিকতা—সইবেন আলো। রাষ্ট্রের ওপর দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এখনই সময়—বৈষম্যের এই দীর্ঘ প্রহর শেষ করার, শিক্ষকের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার ও এক শিক্ষনার ইতিহাস গড়ার। কারণ তারা শুধু শিক্ষায় নেই; তারা আমাদের ভবিষ্যৎ।

রাজপথে আন্দোলন আসলে শিক্ষকদের শুধুই বেতন ভাতার জন্যই নয়, এটি আসলেই একটি শিক্ষাধারার বাঁচার লড়াই। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা কেবল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়—এটি গ্রামীণ শিক্ষার প্রাণ, নৈতিকতার শিকড়, দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার আশ্রয়। এই মাদরাসাগুলো বাঁচানো মানে এক প্রজন্মের নৈতিক শিক্ষা রক্ষা করা, এক সমাজের আত্মা বাঁচানো।

রাষ্ট্র যদি সত্যিই “সবার জন্য শিক্ষা”র অঙ্গীকারে বিশ্বাস করে, তবে এখনই প্রয়োজন—

  • দ্রুত জাতীয়করণ,
  • সমমর্যাদার বেতন কাঠামো,
  • শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন,
  • এবং শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি পুনরায় চালু করা।

অন্যথায়, ইবতেদায়ি মাদরাসার ইতিহাস একদিন পাঠ্যবইয়ের ফুটনোটে হারিয়ে যাবে— যেখানে লেখা থাকবে: তারা শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু স্বীকৃতি পাননি।

শেষে একটি প্রশ্ন রেখে যাই:
আমরা কি এমন এক সমাজ চাই, যেখানে নৈতিকতার শিক্ষক ক্ষুধার্ত থাকে, আর ন্যায়বিচার কাগজে বন্দী?
নাকি আমরা সাহস করব এই অবিচারের অবসান ঘটাতে—
তাদের জন্য, যাদের হাতে আমাদের ভবিষ্যৎ শিশুর প্রথম অক্ষর লেখা হয়?

রাষ্ট্রের দায়িত্ব অবিলম্বে এই বৈষম্যের অবসান ঘটানো। সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার জাতীয়করণ বাস্তবায়ন, এমপিও অনুমোদন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এই শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নন—তারা জাতির মূলভিত্তি।

এ বিষয়ে সম্পাদকীয় “রাস্তায় শিক্ষক কেন? — অবহেলিত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার মর্যাদার লড়াই ” পড়ুন :

✍️  অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

 #শিক্ষকদেরমর্যাদা #স্বতন্ত্রইবতেদায়ীমাদ্রাসা #জাতীয়করণ_এখনই #শিক্ষাক্ষেত্রেঅবিচার #শিক্ষাহলেপ্রধান_অগ্রাধিকার 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: