odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Sunday, 9th November 2025, ৯th November ২০২৫
চীনের আধিপত্য ভাঙতে নতুন খনিজ ফ্রন্টিয়ারে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর নজর। অবকাঠামো ও পরিবেশগত বাধা সত্ত্বেও গ্রীনল্যান্ডে খনিজ খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।

খনিজ যুদ্ধে নতুন ফ্রন্টিয়ার: গ্রীনল্যান্ডের দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দৃষ্টি

Special Correspondent | প্রকাশিত: ৮ November ২০২৫ ২১:৪৬

Special Correspondent
প্রকাশিত: ৮ November ২০২৫ ২১:৪৬

আন্তর্জাতিক ডেস্ক  

চীনের একচেটিয়া দখল থেকে মুক্তি পেতে রেয়ার আর্থ খনিজ আহরণে নতুন দিগন্ত হিসেবে উঠে আসছে গ্রীনল্যান্ড। মোবাইল ফোন থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি, এমনকি যুদ্ধবিমান পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির প্রায় সবখানেই অপরিহার্য এই খনিজ উপাদানগুলোর খনন এখন ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। দক্ষিণ গ্রীনল্যান্ডের কিল্লাভাত আলানগুয়াত পর্বতের পাদদেশে দাঁড়িয়ে প্রকল্পটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO) টনি সেইজ ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন ভবিষ্যৎ খনির দিকে। তিনি বলেন, আমরা এখানে দুটি খনন এলাকা নিয়ে কাজ শুরু করব। এই লালচে পাথরটাই আসল লক্ষ্য এখানেই রয়েছে মূল্যবান রেয়ার আর্থ উপাদান। ট্যানব্রিজ নামে পরিচিত প্রকল্পটি প্রায় ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং এটি গ্রীনল্যান্ডের সবচেয়ে বড় রেয়ার আর্থ খনিজক্ষেত্রগুলোর একটি। রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস বা বিরল পৃথিবী ধাতু আসলে খুব বিরল নয়। তবে এগুলো আহরণ ও প্রক্রিয়াজাত করা অত্যন্ত কঠিন। ১৭টি ধাতু যেমন নিওডিমিয়াম, টার্বিয়াম, ইট্রিয়াম ইত্যাদি, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীর ভিত্তি। স্মার্টফোন, টিভি স্ক্রিন, ইলেকট্রিক গাড়ির মোটর, উইন্ড টারবাইন কিংবা যুদ্ধবিমানের F-35 জেট সবখানেই এর ব্যবহার অপরিহার্য। বর্তমানে বিশ্বের ৬০% রেয়ার আর্থ চীনে উত্তোলিত হয় এবং ৯০% এর বেশি প্রক্রিয়াজাতকরণও চীনের হাতে। এই আধিপত্য ভাঙতেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো নতুন উৎস খুঁজছে এবং তাদের নজর এখন গ্রীনল্যান্ডে।২০১৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ড কিনতে চান বলে মন্তব্য করলে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। গ্রীনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইয়েন্স ফ্রেডরিক নিলসেন স্পষ্ট ভাষায় বলেন, গ্রীনল্যান্ড কোনো বিক্রয়ের সম্পত্তি নয়। তবু ট্রাম্প প্রশাসন তখন থেকেই এই অঞ্চলে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহ দেখায়। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর ও ইউরোপীয় দেশগুলোও সম্ভাব্য খনিজ সরবরাহের জন্য গ্রীনল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। ট্যানব্রিজ প্রকল্পের খনি এখনো চালু হয়নি। এলাকা এত দুর্গম যে সেখানে পৌঁছানো যায় শুধু হেলিকপ্টার বা নৌপথে। কোনো রাস্তা নেই সব অবকাঠামো খনন প্ল্যান্ট, বাসস্থান ও ডক তৈরি করতে হবে একদম শুরু থেকে। প্রকল্পটির প্রতিষ্ঠাতা ভূতাত্ত্বিক গ্রেগ বার্নস মনে করেন এখানে এত বেশি আকরিক আছে যে হাজার বছর খনন করলেও ফুরাবে না প্রকল্পটি মার্কিন প্রতিরক্ষা সম্পৃক্ত দুটি কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের Export-Import Bank থেকে ১২ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে।

গ্রীনল্যান্ডের আয়তন দুই মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার যার বেশিরভাগই বরফে ঢাকা। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত ৩০টির মধ্যে ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান এখানেই পাওয়া যায়। গ্রীনল্যান্ডের অর্থনীতি মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের যার বড় অংশই ডেনমার্কের অনুদান ও মাছ রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। তাই সরকার খনিজ খাতকে ভবিষ্যতের প্রধান আয়ের উৎস হিসেবে দেখছে। ব্যবসা ও খনিজমন্ত্রী নাজা নাথানিয়েলসেন আশা করছেন, আগামী ১০ বছরে অন্তত তিন থেকে পাঁচটি নতুন খনি চালু হতে পারে। তবে কঠিন আবহাওয়া, অবকাঠামোর ঘাটতি ও পরিবেশগত কঠোর আইন এই পথের বড় বাধা। বর্তমানে দেশে মাত্র দুটি সক্রিয় খনি রয়েছে। সব প্রকল্পই যে এগোচ্ছে তা নয়। সবচেয়ে বড় খনিজক্ষেত্র কুয়ানার্সুইত (Kvanefjeld) প্রকল্পটি ইউরেনিয়াম উপস্থিতির কারণে তীব্র জনবিরোধে আটকে গেছে এবং আইনি জটিলতায় রয়েছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান Eclipse Metals, কানাডার Neo, এবং ব্রিটিশ Alba Resources ইতিমধ্যে দক্ষিণ গ্রীনল্যান্ডে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। দক্ষিণাঞ্চলের শহর কাকোর্টক এ নতুন বিমানবন্দর ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। কুজাল্লেক মিউনিসিপালিটির মেয়র ম্যালিনে ভাহল রাসমুসেন বলেন আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে অন্তত তিনটি খনি চালু হতে পারে। এতে স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থান বাড়বে। তবে অনেকে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত খনন কার্যক্রম স্থানীয় প্রকৃতি, মৎস্য ও শিকার সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। গ্রীনল্যান্ড এখন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এক নতুন কেন্দ্রে। বরফে ঢাকা এই দ্বীপে ছড়িয়ে থাকা রেয়ার আর্থ খনিজ শুধু বৈজ্ঞানিক নয় কৌশলগতভাবেও পশ্চিমা বিশ্বের পরবর্তী গেমচেঞ্জার হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এই কঠিন পরিবেশ, বিপুল ব্যয় ও স্থানীয় জনগণের উদ্বেগের মাঝে গ্রীনল্যান্ড কি সত্যিই নতুন মাইনিং ফ্রন্টিয়ার হয়ে উঠবে?

-মো: সাইদুর রহমান (বাবু), বিশেষ প্রতিনিধি. অধিকারপত্র



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: