odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Thursday, 20th November 2025, ২০th November ২০২৫
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তার রেখে যাওয়া সৃষ্টিশীলতা এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। গান, গদ্য, প্রতিবাদ বহুমাত্রিক সঞ্জীব একা ও অনন্য।

সঞ্জীব চৌধুরীর ১৮তম প্রয়াণ দিবস আজ: সময়ের দেয়াল পেরিয়ে ফিরে আসে সঞ্জীবের গান

Special Correspondent | প্রকাশিত: ১৯ November ২০২৫ ২২:০০

Special Correspondent
প্রকাশিত: ১৯ November ২০২৫ ২২:০০

নিউজ ডেস্ক │অধিকারপত্র

বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের বহুমুখী প্রতিভা এবং ব্যান্ড দলছুট এর প্রতিষ্ঠাতা, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, কবি এবং সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরীর ১৮তম প্রয়াণ দিবস আজ। প্রেম, প্রতিবাদ, দ্রোহ ও সমাজ সংবেদনশীলতার মিশেলে যিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য সঙ্গীতধারা। সেই শিল্পীকে স্মরণ করছে সংগীতভুবন। তাঁর গানের পরতে পরতে ছিল মানবজীবনের গল্প। সামাজিক অসঙ্গতি, রাজনৈতিক দমন পীড়ন কিংবা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন বেদনা। সবকিছুই তিনি গানে তুলে ধরেছেন নির্ভীক ভাষায়। কখনও আগুনের কথা বলেছেন কখনও রংপুরে পুলিশের হাতে ধর্ষিত তরুণী ইয়াসমিনের প্রতিবাদ ফুটিয়ে তুলেছেন সুরে। আবার টিনেজ প্রেমিকের অনুভূতি ধরা দিয়েছে তার কালজয়ী গান এই নষ্ট শহরে নাম না জানা কোন এক মাস্তান কিংবা রিক্সা কেন আস্তে চলে না। বাংলাদেশের লোকসংগীত ঐতিহ্যের এক অনন্য সৃষ্টি বাউল শাহ আব্দুল করিমের গাড়ি চলে না চলে না নতুন জীবন পেয়েছিল সঞ্জীব চৌধুরীর পরিবেশনায়। দেহতত্ত্বের গভীর মাত্রা ধারণ করা এই গানটি দেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

সঞ্জীবের গান শুধু প্রেম বা বিরহ নয় দ্রোহের ভাষায় উচ্চারিত হত গান। ছিল প্রতিবাদী সুরের ধারাবাহিক বহিঃপ্রকাশ। শাসকদের চোখ রাঙানির মধ্যে সেনাশাসিত অস্থির সময়ে তিনি গানের মধ্য দিয়েই উচ্চারণ করেছেন সত্য। বেয়োনেটের ভীতিকর ছায়ায় দাঁড়িয়েও বলেছেন, ওরা বলে খাদ্য আর পানীয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিন্তু আমি জানি, সেখানে ছিল ৩০০ লাশ ঠাণ্ডা হিম, যাদের গুম করে ফেলা হবে। এভাবেই তিনি গানের ভাষায় জানিয়েছেন শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান। রাজনীতি থেকে সাংবাদিকতা বহুমুখী প্রতিভা কিংবদন্তি এই শিল্পীর ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের মাকালকান্দিতে জন্ম। জমিদার বংশে জন্ম হলেও চিন্তায় চেতনায় তিনি ছিলেন বাম ধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। ছিলেন সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের সম্পাদকও। ঢাবির সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষে আশির দশকে সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। যায়যায়দিনে ফিচার এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত ফিচার বিভাগের যাত্রা তার হাত ধরেই শুরু হয়। ২০০৫ সালে রাজু স্মৃতি ভাস্কর্যের পাদদেশে অনুষ্ঠিত কনসার্ট ফর ফাইটার এর আয়োজন ছিলো প্রতিবাদি এই শিল্পী শ্রেষ্ঠ আয়োজন। যারা উপস্থিত ছিলেন তারা বলতে পারবেন সেদিনের কথা। এমন ভয়হীন উচ্চারণ একমাত্র সমাজমনস্ক, রাজনৈতিকভাবে সচেতন শিল্পীই বলতে পারে। আবার কতটা আবেগী একজন গান করার আগে অনুমতি নিতে হাওর পেরিয়ে চলে গিয়েছিলেন দিরাইয়ের উজানধল গ্রামে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের বাড়িতে। লোকগীতির প্রতি শ্রদ্ধা আর গানের প্রতি এতটাই বিনয়ী ছিলেন সঞ্জীব। গানের ভেতরে শহর মানুষ আর আহত হৃদয়ের সুর মধ্যরাতে ডুবে থাকা মাতাল, অন্ধ করে দেওয়া চাঁদ, নষ্ট শহর যেখানে আকাশও কখনো নিষিদ্ধ এইসবই তাঁর গানের নিত্যসঙ্গী। হাওয়ারে তুই বাজা নূপুর না হয় মনে অসুখ। আমার ছিল বন্ধ কপাট, কেটে নেওয়া মাথা রক্তের ফোটা সেই ছুরি চিকিৎসা। আর কত গান রাত জাগা পথ গানের লাইনগুলো যেন একেকটা ক্ষত, যন্ত্রণার দাগ, আবার একইসঙ্গে প্রেমের তীব্র আকুতি। চোখ নিয়ে তাঁর বিস্ময়, প্রশ্ন কিছুটা আতঙ্ক চোখটা এত পোড়ায় কেন? প্রশ্নেও নেই উত্তর নেই চোখ গেল ধরেছে সুন্দর আবার চোখের মাঝে বসত করে অন্য লোকের চোখ। শেষে এসে দৃশ্যপটটা যেন পাথর আর তার ওপর বসা একটা সানগ্লাস। জগৎবিখ্যাত ভুলে ভরা গানটি সেই গানটি হৃদয় ছুঁয়ে যায় সকলের।

আমি তোমাকেই বলে দেব
কী যে একা দীর্ঘ রাত
আমি হেটে গেছি বিরান পথে
আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়
ছুয়ে কান্নার রঙ
ছুয়ে জোছনার ছায়া।।

সঞ্জীব চৌধুরী দলছুট ব্যান্ডের মাধ্যমে বাংলা ব্যান্ডসংগীতে যে বৈচিত্র্য ও গভীরতা এনে দেন তার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন চারটি অ্যালবাম আহ্ (১৯৯৭), হৃদয়পুর (২০০০), আকাশ চুরি (২০০২) এবং জোছনা বিহার (২০০৭)। প্রতিটি অ্যালবামেই প্রেম, সমাজ, মানবিকতা, শহুরে অনুভূতি ও প্রতিবাদের সুর একসঙ্গে মিশে আছে। যা তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে সংগীতভুবনে। ব্যান্ড অ্যালবামের পাশাপাশি তিনি প্রকাশ করেন নিজের একক অ্যালবাম স্বপ্ন বাজী (২০০৫)। যেখানে ব্যক্তিগত ভাবনা, রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও তীক্ষ্ণভাবে উঠে আসে। দলছুটের অ্যালবামগুলো গড়ে তোলে তার ব্যান্ড পরিচয় আর স্বপ্ন বাজী তাকে একক শিল্পী হিসেবে সমৃদ্ধ করে। এভাবেই ব্যান্ড ও একক অ্যালবাম দুই ধারাতেই সঞ্জীব চৌধুরী বাংলা সংগীতে তৈরি করে গেছেন এক স্বতন্ত্র উত্তরাধিকার। রাশপ্রিন্ট সঞ্জীব চৌধুরীর একমাত্র প্রকাশিত বই। অনেকটা গদ্য ও পদ্যের মিশ্রিত অদ্ভুত সব নির্মাণ। ভেতরে আছে রাশপ্রিণ্ট, নীল ক্লিনিক ও কোলাজ এই তিনটি গদ্যকবিতা। তারই এক অংশে বলা—

অখণ্ড নীরবতা ছিল
কেবল মাঝে মাঝে বাতাসের ফিসফাস
নীরব নীল ঠান্ডা বাতাস ছিল।
মুখের রেখা দেখাই ডাক্তার পড়ে ফেলেন রোগীর অসুখ।
আর কী আশ্চর্য—
সকল ডাক্তারের নাম ডা. জিভাগো।
আর কী আশ্চর্য-
সকল নার্সের নাম সিস্টার নিবেদিতা।
ঘর আগরবাতির গন্ধে সুরভিত হলো,
ঘরে স্বগীয় নীল পারিজাত ফুটল।

২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তার রেখে যাওয়া সৃষ্টিশীলতা এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। প্রতিবাদ, প্রেম ও মানবতার মিশেলে নির্মিত তার গান আজও তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। মৃত্যুদিনে সেই বৈচিত্র্যময় মানুষটিকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ। সঞ্জীব চৌধুরী আজ নেই। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি গান, সুর, মনন, প্রতিবাদ সবই আজও সমান প্রাসঙ্গিক। প্রেম থেকে শুরু করে দ্রোহ বাংলা সংগীতে এমন বহুমাত্রিক উপস্থাপনা বিরল। মৃত্যুদিনে বাংলা সংগীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের যার সৃষ্টির গাড়ি এখনও চলমান, থেমে নেই এক মুহূর্ত।

-মো: সাইদুর রহমান (বাবু), বিশেষ প্রতিনিধি. অধিকারপত্র



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: