odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Saturday, 29th November 2025, ২৯th November ২০২৫
প্লেটোর ডাকে সক্রেটিসের বাংলাদেশের ভ্রমণ। ঢাকায় এসে তাঁর জ্ঞানীর বিস্ময়ে অবলোকন করলেন এমন একটি দেশের যেখানে ক্ষমতা তৈরি করে 'সত্য', আর ডিগ্রি কেবল চাকরির লাইসেন্স।

বঙভূমিতে সক্রেটিসের আগমন ও সত্যের বিষপান: ক্ষমতার দম্ভ, শক্তি ও মিডিয়ার ছায়ায় নৈতিকতার নির্বাসন!

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ২৮ November ২০২৫ ১৭:১০

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ২৮ November ২০২৫ ১৭:১০

"সত্যই বিজয়ী" বিলবোর্ড দেখে সক্রেটিসের প্রশ্ন: এই 'সত্য' কি বিষপানের থেকেও কঠিন? ক্ষমতার থিয়েটার, গুজবের জাদু আর ডিগ্রীর মোহে শিক্ষার বেহাল দশা —ঢাকা সমাজের অদ্ভুত রসায়ন নিয়ে এক দার্শনিক ব্যঙ্গ।

তৃতীয় পর্ব: সক্রেটিসের চোখে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের আত্মদর্শন

এই নিবন্ধটি গ্রিসের মহাজ্ঞানী দার্শনিকেদের কেন্দ্র করে রচিত একটি ধারাবাহিক সিরিজের তৃতীয় পর্ব। এই পর্বে শিষ্য প্লেটোর অনুরোধে ঢাকার পথে পা রাখেন সক্রেটিস। এর আগে প্লেটো শিষ্য এরিস্টটলের নির্বাক প্রত্যাবর্তনের পর, প্লেটো ঢাকায় পৌঁছেছিলেন।

আজকের নিবন্ধে সক্রেটিসের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার এক সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ণ ও চিন্তাপ্রবণ বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। এই পর্বে পাঠক প্রত্যক্ষ করবেন— কীভাবে নৈতিকতা, সত্য, শিক্ষা ও নাগরিক চেতনার প্রশ্ন আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক জটিল, ব্যঙ্গমিশ্রিত, অথচ গভীরভাবে ভাবনায় নিমগ্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছে।

আজকের নিবন্ধটি পুরোপুরি বোঝার জন্য আমরা পাঠককে অনুরোধ করছি আগের পর্ব-দুইটি পড়তে:

  1. ১ম পর্ব [পড়ুন এখানে] জ্ঞান, নৈতিকতা, শিক্ষা ও নাগরিক চেতনায় পতনের গল্প—আধুনিক ঢাকার বাস্তবতায় এরিস্টটলের চিরন্তন দর্শনের পুনরালোচনা। মৃত্যুর ২৩৪৭ বছর পরে এরিস্টটলের কান্না: কালজয়ী ছয়টি বাণীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া!
  2. ২য় পর্ব: [পড়ুন এখানে]: এরিস্টটলের পরে প্লেটো এবার বাংলাদেশে: ঢাকার চায়ের দোকানে গ্রিক দর্শনের টাইম-ট্রাভেল। প্লেটোর চোখে কেন আজও ছায়াকেই বাস্তব ধরে বাঙালি? প্লেটো, এরিস্টটলের দীর্ঘশ্বাস ও বাংলাদেশের বর্তমান: গুহা থেকে সিন্ডিকেট-লজিক

বিষপান করে হাসি! কিন্তু ঢাকায় এসে সক্রেটিসের হাসি থামল কেন?

সত্যের জন্য হাসিমুখে বিষপান করেছিলেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিস। সেই 'সত্য'-এর খোঁজে শিষ্য প্লেটোর অনুরোধে তিনি যখন ঢাকার রাজপথে পা রাখলেন, তখন তাঁর ঠোঁটে আর হাসি ফুটল না। বিষের পাত্র নয়, বরং তিনি দেখলেন এক ভিন্ন, আরও তীক্ষ্ণ এবং হৃদয়বিদারক ব্যঙ্গাত্মক সত্যের রূপ।

ঢাকার ভিড়ের মাঝে বিশাল এক বিলবোর্ড জ্বলজ্বল করছে— “সত্যই বিজয়ী”। শব্দটি দেখে প্রখ্যাত এই দার্শনিক মুচকি হেসেছিলেন, তবে সেই হাসি ক্রমশ ভাবনায় মিশে গেল। তিনি কি বিষপান করে যে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এই দেশের 'বিজয়ী সত্য' কি তার থেকেও জটিল?

রাজপথ থেকে অফিস, মিডিয়া থেকে আদালত—সবখানে তিনি দেখলেন, সত্যের অর্থ রাষ্ট্রের ক্ষমতার আয়তনে সীমাবদ্ধ। যেখানে পেশীশক্তি বা রাজনৈতিক প্রভাব সত্য তৈরি করে10, আর মিডিয়ার কাজ কেবল তাকে জনসাধারণের সামনে পরিবেশন করা। চিৎকার, প্রতিবাদ—সবই শূন্যে মিলিয়ে যায়, কারণ আইন-আদালতও ক্ষমতার তৈরি সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য। সক্রেটিস বুঝলেন, এই দেশে সত্য কেবল একটি তত্ত্ব নয়, এটি কখনো কখনো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক নাটক।

দেশের রাজপথ, অফিস, মিডিয়া—সবখানে তিনি দেখলেন যে সত্য বলতে যে অর্থ বোঝানো হয়, তা আসলে রাষ্ট্রের ক্ষমতার আয়তনে সীমাবদ্ধ। বড় বড় পেশীশক্তি বা রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেই সত্য তৈরি হয়, আর মিডিয়ার কাজ শুধু সেই সত্যকে মাখা খেয়ে জনসাধারণের সামনে পরিবেশন করা।

সক্রেটিস খেয়াল করলেন, জনতার চিৎকার, প্রতিবাদ, কিংবা আদালতে জবাবদিহি—সবই কেবল শূন্যে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। মানুষ জানে, যতই চিৎকার করুক, আইন আদালত তাদের কথাকে সত্য হিসেবে মেনে নেবে না। এখানে সত্য এবং ন্যায় স্বাধীন নয়; তারা সংজ্ঞায়িত হয় ক্ষমতার দ্বারা।

সক্রেটিস’এর হাসি ক্রমশ ভাবনায় মিশে গেল। তিনি দেখলেন, গুজব মানুষকে প্রান দান করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও মানে একটি জাদুকরী সত্য। শিক্ষকের সম্মান ক্রমেই ক্ষয় পাচ্ছে, গুরুদের অবমাননা সাধারণ। মানুষকে শেখানো হচ্ছে যে শক্তিই নৈতিকতার মানদণ্ড।

সে রাতেই তিনি নদীর ধারে বসে ভাবলেন—“সত্য কি কেবল শব্দের খেলো নয়? নাকি এটাও শুধু রাষ্ট্রের থিয়েটার?” তিনি হেসে হেসে নিজের চিন্তায় নিখোঁজ হয়ে গেলেন।

সক্রেটিস বাংলাদেশের এই ভ্রমণ থেকে যা শিখলেন তা হলো—সত্য শুধুমাত্র একটি তত্ত্ব নয়, এটি কখনো কখনো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক নাটক। আর এই নাটকে সবাই অভিনেতা, কিন্তু কিছু মানুষই কৌতুকের ছদ্মবেশ ছাড়া সত্যের সন্ধান পায় না।

শেষমেষ, সক্রেটিস বুঝলেন—এদেশে সত্যের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে, হাস্যকর হলেও হৃদয়বিদারক। তিনি তার ছোট্ট নোটবুকে লিখলেন—“যে দেশে শক্তিই সত্য নির্ধারণ করে, সেখানে দর্শকরা হাসবে, কিন্তু দর্শকও জানে, সত্যের মুখোশ কখনও ছিঁড়ে যাবে।”

সক্রেটিসের বাংলাদেশ ভ্রমণ ও অসঙ্গতির দর্শন

এক. পিরিচে ঢাকা 'দ্রুতগামী উল্কা': স্থিরতার মহাসমুদ্রে সক্রেটিসের প্রথম পাঠ

জ্ঞানতাপস সক্রেটিস! প্রাচীন গ্রিসের সেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা দার্শনিক , যিনি এলেন আমাদের এই ষড়ঋতুর বাংলাদেশে। তিনি এলেন একটি বাসে চড়ে, যার নাম 'দ্রুতগামী উল্কা'! সক্রেটিস ভাবলেন, গতি তবে নিশ্চয়ই তাঁর চিন্তার চেয়েও বেশি! কিন্তু তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল, যখন বাসটি জ্যামের(Traffic Jam) মহাসমুদ্রে এক ইঞ্চি করে নড়তে শুরু করলো। এ যেন শব্দের জাদুকর আর বাস্তবের কচ্ছপের মধ্যে এক নিদারুণ প্রতিযোগিতা।

প্রথমেই তিনি তার চেনা পদ্ধতি প্রয়োগ করলেন। পাশে বসা এক যুবককে জিজ্ঞেস করলেন, "হে বন্ধু, তোমরা এই যানের নাম দিয়েছো 'দ্রুতগামী'? তবে কি 'দ্রুতগামী' শব্দের অর্থ এই দেশে 'ধীরে চলো, মাঝে মাঝে থেমো'?"

যুবক হেসে উত্তর দিল: "আরে গুরু, এটা নাম! অনুভূতিটাই আসল। আমরা বিশ্বাস করি, এইটুকু এগোতে পারা মানেই দ্রুত! আর তাছাড়া, বাসওয়ালা বলে, 'গাড়ি তো চালাইতেই চাই, কিন্তু রাস্তা দেয় না!'

সক্রেটিস বিড়বিড় করে উঠলেন:"তাহলে কি এই দেশের আধুনিক সফিস্টদের প্রথম শিক্ষা হলো: কর্মের দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে স্বস্তি লাভ করা?" তিনি বুঝলেন, এ কেমন পরিহাস! দেশবাসী মুখে গতির জয়গান গেয়েও প্রতি মুহূর্তে স্থবিরতার কাছে আত্মসমর্পণ করছে।

দুই. বিলবোর্ডের সততা বনাম বাজারের সুবিধাবাদ: নৈতিকতার 'জাতীয় বিনোদন'

দার্শনিক হাঁটছেন ঢাকার ভিড়ে । তাঁর অনুসন্ধিৎসু চোখ যখন সত্য আর সৌন্দর্য খুঁজছে , তখনই তিনি দেখলেন এক বিশাল বিলবোর্ড: "দেশপ্রেম, সততা ও মানবিকতায় আমরা আপোষহীন!"

সক্রেটিস খুশি হয়ে উঠলেন। তিনি ভাবলেন, তাঁর অনুসন্ধিৎসু আত্মা অবশেষে শান্তি পাবে । তিনি পাশের এক চায়ের দোকানে বসলেন। অবশেষে তাঁর অনুসন্ধিৎসু আত্মা শান্তি পাবে। তিনি পাশের এক চায়ের দোকানে বসলেন।চা-ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন: "চমৎকার! এই আপোষহীন মূল্যবোধের চর্চা কি এই দেশের সর্বত্র দেখা যায়?"

চা-ওয়ালা মুচকি হেসে উত্তর দিল, "গুরু, এটা তো প্রচারণা। আর প্রচারণা সব সময় অনুশীলন নাও হতে পারে।" সক্রেটিস প্রশ্ন করলেন: "তাহলে কি এই মূল্যবোধের চর্চা শুধুমাত্র 'অফ-পিক আওয়ার'-এ প্রযোজ্য?" চা-ওয়ালা কাপ ধুতে ধুতে বললো, "আসলে কী জানেন? আমরা সবাই চাই দেশটা ভালো হোক, কিন্তু আমি ভালো হয়ে শুরু করতে চাই না। আমরা চাই, অন্যেরা সৎ হোক, যাতে আমার সুবিধা হয়।"

সক্রেটিসের চোখে কপালে উঠলো! তিনি বললেন, "তোমাদের রাষ্ট্রের আদর্শ আর ব্যক্তির আচরণে এত বড় বিচ্ছিন্নতা? এই ফারাকটাই কি তোমাদের জাতীয় বিনোদন?"

তিনি বুঝলেন, এখানে আদর্শ কেবলই এক সাজসজ্জার উপকরণ, যার ব্যবহার শুধুমাত্র প্রদর্শনের জন্য। সক্রেটিসের চোখ কপালে উঠলো। তিনি বললেন, "এ কী কথা! তোমাদের রাষ্ট্রের আদর্শ আর ব্যক্তির আচরণে এত বড় বিচ্ছিন্নতা? তোমরা কি জানো, যে জিনিসটা তোমরা মুখে বলো আর যেটা বাস্তবে করো, এই দুয়ের মধ্যে বিরাট ফারাক?"

চা-ওয়ালা মাথা চুলকে বললো, "জানি। এই ফারাকটাই তো আমাদের জাতীয় বিনোদন!"

তিন. জ্ঞান আর চাকরির টিকিট: যখন সার্টিফিকেটই সত্যের চেয়ে মূল্যবান

সক্রেটিস গেলেন এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তিনি জানতে চাইলেন, "তোমরা কাকে জ্ঞানী বা শিক্ষিত বলো?" একজন ছাত্রের সহজ উত্তর: "যাদের লম্বা ডিগ্রী আছে, যারা ভালো চাকরি পায়, তারাই শিক্ষিত।"

সক্রেটিস স্মরণ করলেন: তিনি তো ভাবতেন, জ্ঞান মানে হলো আত্ম-অনুসন্ধান, নিজের অজ্ঞতা স্বীকারের সাহস! সক্রেটিস বললেন, "কিন্তু আমি তো ভাবতাম, জ্ঞান মানে হলো আত্ম-অনুসন্ধান, নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করার সাহস এবং ন্যায়-অন্যায়ের ভেদ জানা।"

ছাত্রটি হেসে জবাব দিল: "গুরু, ওসব হলো পুরাতন মডেল। এখন ডিগ্রি হলো একটা লাইসেন্স। লাইসেন্স থাকলে আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারবেন, এমনকি ভুল হলেও।" সক্রেটিস জিজ্ঞেস করলেন: "তোমরা কি সত্যই বিশ্বাস করো, এই কাগজের টুকরাটি বুদ্ধি বা চরিত্রের প্রতিচ্ছবি?" ছাত্রের চূড়ান্ত উত্তর: "আসলে, কাগজটা আমাদের পেটের প্রতিচ্ছবি। জ্ঞান থাক বা না থাক, পেট চালাতে কাগজটা লাগে।" সক্রেটিস হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি বুঝলেন, এই দেশে সত্যের চেয়েও সার্টিফিকেটের মূল্য বেশি। জ্ঞান এখানে আর আলোর মশাল নয়, বরং কেবলই চাকরি খোঁজার টিকিট।

সক্রেটিস হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি বুঝলেন, এই দেশে সত্যের চেয়েও সার্টিফিকেটের মূল্য বেশি। জ্ঞান এখানে আর আলোর মশাল নয়, বরং কেবলই চাকরি খোঁজার টিকিট।

চার. অসঙ্গতির দর্শন: শব্দের জাদুকর থেকে নগ্ন সুবিধাবাদে আত্মসমর্পণ

দার্শনিক সক্রেটিস বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম যে অসঙ্গতিটি দেখলেন, তা হলো নামের সাথে কাজের চরম দূরত্ব। দার্শনিক সক্রেটিস প্রথম যে অসঙ্গতিটি দেখলেন, তা হলো নামের সাথে কাজের চরম দূরত্ব। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে যাকে ‘দ্রুতগামী উল্কা’ নামে ডাকা হলো, সেটি কিনা মহাসড়কের বুকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে—যেন এক ধ্যানমগ্ন যোগী, যার গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া নেই। এ যেন শব্দের জাদুকর আর বাস্তবের কচ্ছপের প্রতিযোগিতা। এই অসঙ্গতি প্রমাণ করে, স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যবর্তী সেতুটি জ্যামের সমুদ্রে নিমজ্জিত।

এরপর তিনি দেখলেন আরও গভীর এক নৈতিক বিভেদ। এরপর তিনি দেখলেন আরও গভীর এক নৈতিক বিভেদ। শহরজুড়ে বিশাল বিলবোর্ডগুলি যেন ‘আপোষহীন সততা ও আদর্শের’ কথা চিৎকার করে ঘোষণা করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সুবিধাবাদ যেন এক অলিখিত জাতীয় নীতি। এ যেন এক দ্বিচারিতা: জনসমক্ষে উচ্চ আদর্শের পোশাক পরে থাকা আর ব্যক্তিগত জীবনে সেই পোশাক ছিঁড়ে ফেলে নগ্ন সুবিধাকে আলিঙ্গন করা।সক্রেটিস বুঝলেন, এখানে আদর্শ কেবলই প্রদর্শনের উপকরণ।

তাঁর কাছে তৃতীয় যে অসঙ্গতিটি ধরা পড়লো, তা হলো জ্ঞান ও শিক্ষার সংজ্ঞাগত বিপর্যয়। তাঁর কাছে তৃতীয় যে অসঙ্গতিটি ধরা পড়লো, তা হলো জ্ঞান ও শিক্ষার সংজ্ঞাগত বিপর্যয়।সক্রেটিস আজীবন বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান হলো আত্ম-অনুসন্ধান। অথচ এই দেশে এসে দেখলেন, শিক্ষা এখন আর অন্তরের আলো নয়, এটি হলো কেবলই চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরার প্রবেশপত্র, অর্থাৎ একটি ডিগ্রী। জ্ঞান পরিণত হয়েছে এক বাজারজাত পণ্যে , যার নৈতিক বা দার্শনিক মূল্য গৌণ।

লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী জ্ঞানার্জনের প্রকৃত আনন্দ ও সত্যের প্রতি আগ্রহ ভুলে গিয়ে শুধু মাত্র কাগজের সেই সনদ অর্জনের জন্য ছুটছে। এই ডিগ্রি তাদের পেটের ক্ষুধা মেটাতে পারে, কিন্তু আত্মার ক্ষুধা মেটাতে পারে না। সক্রেটিস উপলব্ধি করলেন, এখানে আত্মিক সমৃদ্ধি নয়, বরং পেশাগত নিরাপত্তা অর্জন করাই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে জ্ঞান পরিণত হয়েছে এক বাজারজাত পণ্যে, যেখানে এর নৈতিক বা দার্শনিক মূল্য গৌণ।

সবশেষে, দার্শনিক অনুভব করলেন এই জাতির এক অদ্ভুত জীবনবোধ: সমস্যাকে সমাধান করার চেয়ে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। মুখে সবাই উন্নত সমাজের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে, কিন্তু বাস্তবে চ্যালেঞ্জ এলে তার মূলে আঘাত না হেনে, বরং সেই সমস্যার সাথে সহাবস্থান করার কৌশল বেছে নেয়। এ যেন নদীতে ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে সাঁতার না শিখে, বরং ভেসে থাকা শ্যাওলাকে আঁকড়ে ধরা। সক্রেটিস বুঝলেন, এই 'মানিয়ে নেওয়া'র মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় সেই জাতীয় অলসতা, যা সমস্ত অসঙ্গতিকে চিরস্থায়ী করে তোলে ।

সক্রেটিস বুঝলেন, এই মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় সেই জাতীয় অলসতা, যা সমস্ত অসঙ্গতিকে চিরস্থায়ী করে তোলে। এটি সেই চরম দার্শনিক অসঙ্গতি, যেখানে ইচ্ছা ও কর্মের মাঝখানে একটি বিশাল 'যদি-কিন্তু' দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে, এবং সেই দেয়াল টপকানোর চেয়ে তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াই এখানকার মানুষের কাছে শ্রেয়।

 সক্রেটিস বাংলাদেশের পথে: সত্য, শক্তি এবং হাস্যকর দর্শন

সক্রেটিস হাসতে হাসতে বিষপান করেছিলেন, কারণ সত্য প্রতিষ্ঠা করা তার জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য ছিল। কিন্তু সেই সত্য যে একদিন তাকে বাংলাদেশের রাজপথে অবাক করবে, তা তিনি কখনো কল্পনাও করতে পারেননি।

ঢাকার গরম দুপুরে, সক্রেটিস এক বিশাল বাজারের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলেন। চারপাশে হট্টগোল, চিৎকার, মানুষের ব্যস্ততা, এবং স্লোগান দিয়ে ভরা বড় বড় বিলবোর্ড—“সত্যই বিজয়ী।” সক্রেটিস থেমে দাঁড়ালেন, ভ্রু উঁচু করে মুচকি হাসলেন, “এই ‘সত্য’ কীভাবে বিজয়ী হলো, তা বোঝার জন্য আবার কি আমাকে এক কাপ বিষপান করতে হবে?”

সক্রেটিস’এর চোখে পড়ল, মিডিয়ার ক্যামেরা, টেলিভিশনের স্ক্রিন, সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড—সবই ক্ষমতাসীনদের ন্যারেটিভকে সোনার আবরণে মোড়ানো। মানুষের চিৎকার, আদালতের দরজা কড়া করে চাপা দেওয়া—সবই যেন শূন্যে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। “এখানকার সত্য,” সক্রেটিস ভাবলেন, “সর্বত্রই ক্ষমতার নকশা অনুযায়ী তৈরি। নৈতিক জ্ঞান আর বিচার নেই।”

তিনি হাঁটতে হাঁটতে এক স্কুলের পাশে এলেন। শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত মোবাইল স্ক্রিনে, শিক্ষকরা ক্লাসরুমে নিঃশব্দ। সক্রেটিস মনে মনে বললেন, “শিক্ষা কি কেবল তথ্যের যোগান, নাকি আত্মমুখী চিন্তা ও নৈতিক বিকাশ?” এখানে সে উত্তর খুঁজে পেল না। শিক্ষকরা সম্মান হারাচ্ছে, গুরুদের অবমাননা সাধারণ, আর সমাজের মানুষ গুজবের চুম্বকে জীবনযাপন করছে।

রাত্রি নামতেই সক্রেটিস নদীর ধারে বসলেন। নদীর ধীরে বয়ে যাওয়া জল, বাতাসের হালকা শীতল স্পর্শ, আর দূরে দূরে শহরের হট্টগোল—সব মিলিয়ে একটি অদ্ভুত শান্তি তৈরি করেছিল। তিনি চিন্তা করলেন, “সত্য কি কেবল শক্তির প্রতিচ্ছবি? নাকি এটাও একটি নাটক, যেখানে সবাই অভিনেতা, কিন্তু কেউ সত্য জানতে পারে না?”

নদীর তীরে বসে তিনি তার নোটবুকে লিখলেন— "যে দেশে শক্তিই সত্য নির্ধারণ করে, সেখানে মানুষ চিৎকার করলেও আইন, বিচার এবং মিডিয়া তা গ্রহণ করে না। সত্যকে অঙ্গীকার করতে হলে কেবল সাহস নয়, নৈতিক শক্তি দরকার।"

সক্রেটিসের চোখে হাসি মেশা হতাশা। তিনি বুঝলেন, এদেশে সত্যের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে—হাস্যকর হলেও গভীরভাবে চিন্তাজাগানো। মানুষ নৈতিকতার জন্য লড়াই করছে, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়মের ভারে তাদের কণ্ঠ চাপে।

সক্রেটিস’এর ভ্রমণ এখানেই শেষ নয়। তিনি জানেন, সত্য এবং ন্যায়ের সন্ধান এমন দেশে আরও কঠিন। কিন্তু সেই সন্ধানেই জীবনের রস, তার দর্শনের মূল—যেখানে নৈতিকতা, বিবেক এবং আত্ম-জ্ঞানই চূড়ান্ত শক্তি।

সক্রেটিস হাসলেন, আবার বিষপান না করেই। কারণ এখানে সত্য খুঁজতে হলে, হাস্যরস আর চোখ খোলা মন একসাথে লাগবে।

বিদায় পর্ব: সক্রেটিসের উপসংহার

বিমানবন্দরে ফেরার পথে সক্রেটিসের মুখে আর হাসি নেই। তিনি সহযাত্রীকে বললেন: "আমি গ্রিসে বলতাম, 'জানার চেষ্টা করাই জীবনের সার্থকতা'। কিন্তু তোমাদের দেশে এসে দেখলাম, 'না জানার ভান করাই জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য'।" তিনি আরো যোগ করলেন: "তোমাদের দেশে অসঙ্গতিই হলো সবচেয়ে বড় সঙ্গতি। তোমরা মুখে এক কথা বলো, আর হৃদয়ে অন্য কথা রাখো। এটা কি এক ধরনের জাতীয় অভ্যাস?"

সহযাত্রী হেসে বললো, "গুরু, এটা হলো 'মানিয়ে নেওয়া'। আমরা বিশ্বাস করি, সমস্যা সমাধান করার চেয়ে সমস্যাকে মানিয়ে নিলে জীবন আরো সহজ হয়।"

সক্রেটিস গভীরভাবে ভাবলেন। তার চোখে ভেসে উঠলো জ্যামের মধ্যে 'দ্রুতগামী উল্কা', সততার বিলবোর্ড আর পেটের দায়ে ডিগ্রি খোঁজা ছাত্রের মুখ।

জ্যামের 'দ্রুতগামী উল্কা', সততার বিলবোর্ড, আর পেটের দায়ে ডিগ্রি খোঁজা ছাত্রের মুখ তাঁর চোখে ভেসে উঠলো। গভীর চিন্তার পর তিনি উচ্চারণ করলেন তাঁর ভ্রমণলব্ধ চূড়ান্ত জ্ঞান: "আমি এক এমন দেশ দেখলাম, যেখানে মানুষ আলো জ্বালায় আঁধার দূর করার জন্য নয়, বরং আঁধারকে আরও স্পষ্টভাবে দেখার জন্য!"

এরপরে তিনি উপসংহার টানলেন: "বাংলাদেশ, তুমি হয়তো এক অসঙ্গতির জাদুঘর। তবে এই অসঙ্গতির মধ্যেই তোমাদের জীবনের এক অদ্ভুত রসায়ন লুকিয়ে আছে, যা আমার গ্রিসের সরল যুক্তির অতীত”।

— এই কথা বলেই সক্রেটিস টাইম-ট্রাভেল যানে আরোহণ করলেন। বিদায়ের মুহূর্তে শেষবারের মতো বললেন, “আমি ফিরে যাচ্ছি— তবে তোমাদের দেশের বিষয়গুলো নিয়ে আমি, আমার শিষ্য প্লেটো এবং তাঁর শিষ্য এরিস্টটল গভীর আলোচনা করবো। প্রয়োজনে সৃষ্টিকর্তার সাথেও পরামর্শ করবো!

এরপরই তার টাইম-ট্রাভেল যানটি ধীরে ধীরে আকাশে উড়াল দিল, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল দূর নীলিমায়। তিনি ফিরে গেলেন সেই অনন্ত রাজ্যে— যেখানে যুক্তি, জিজ্ঞাসা ও প্রজ্ঞার অধিষ্ঠান।

আর বাংলাদেশ?

সে রয়ে গেল নিজস্ব আবেগ, আশা ও অসঙ্গতির স্বরলিপিতে বাজতে থাকা এক অতল গানের দেশে।

ডিসক্লেইমার: এই লেখাটি কল্পনাপ্রসূত ও রূপকধর্মী। সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সমসাময়িক বাস্তবতাকে ব্যঙ্গ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখাটির উদ্দেশ্য একমাত্র চিন্তাশীল পাঠের অনুপ্রেরণা দেওয়া, বাস্তব ব্যক্তি বা ঘটনার সঙ্গে মিল কাকতালীয়।

✍️ অধ্যাপক . মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

পরবর্তী পর্ব (চোখ রাখুন) তিন দার্শনিকের বাংলাদেশের অসঙ্গতি নিয়ে স্বর্গে আলোচনা ও সৃষ্টিকর্তার সাথে ডায়ালগ!

#সক্রেটিস_ঢাকায় #নৈতিকতার_সংকট #শক্তিই_সত্য #বাংলাদেশের_অসঙ্গতি #গুজব_সমাজ #ডিগ্রীর_ফাঁদ #সামাজিক_ব্যঙ্গ #ড.মাহবুবলিটু

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: