odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 26th November 2025, ২৬th November ২০২৫
জ্ঞান, নৈতিকতা, শিক্ষা ও নাগরিক চেতনায় পতনের গল্প—আধুনিক ঢাকার বাস্তবতায় এরিস্টটলের চিরন্তন দর্শনের পুনরালোচনা।

মৃত্যুর ২৩৪৭ বছর পরে এরিস্টটলের কান্না: কালজয়ী ছয়টি বাণীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া!

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ২৫ November ২০২৫ ২৩:৫৯

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ২৫ November ২০২৫ ২৩:৫৯

—উপসম্পাদকীয়

ঢাকার সমাজ আজ কেন জ্ঞানবিমুখ, রাজনীতিকেন্দ্রিক, নৈতিকতাহীন? বাস্তব উদাহরণসহ বিশ্লেষণ—এরিস্টটলের ছয় কালজয়ী বাণী কীভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে আধুনিক বাংলাদেশে।

প্রাচীন গ্রিসের ঋষি এরিস্টটল হাজার বছর আগে যে প্রজ্ঞা বিতরণ করেছিলেন, আজকের এই বঙ্গীয় সমাজে তা যেন কেবলই স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর কালজয়ী বাণীগুলি এখন আর পথের দিশা দেখায় না, বরং সমাজের অস্থিরতা দেখে বিদ্রূপের হাসি হাসে। এই শহরের রাজপথ থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত, দার্শনিকের ছয়টি প্রধান উক্তি কীভাবে তার কার্যকারিতা হারিয়ে অচল হয়ে থমকে গেছে, সেই আখ্যান এখানে বর্ণিত হলো।

দু’হাজার বছরেরও বেশি আগে এরিস্টটল মানবসভ্যতাকে যে ছয়টি চিরন্তন সত্য শোনালেন, সেগুলো যেন আজকের ঢাকার বাতাসে মিলিয়ে গেছে। সময়ের স্রোত বদলেছে, শহরের গায়ে উঠেছে কংক্রিটের চামড়া, মানুষের হাতে উঠেছে স্মার্টফোনের জাদুকাঠি—কিন্তু মননের দরজা? সেগুলো যেন বহু আগেই তালাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। নিচে ধারাবাহিকভাবে দেখা যাক—ঢাকার সমাজ কোন কোন পথে এরিস্টটলের কথা শুনেও না শোনার ভান করে ছুটে চলেছে।

ঢাকা—এক অদ্ভুত শহর। এ শহর নাকি জেগে থাকে রাতেও; অথচ জেগে থাকে শুধু আলো, মানুষ নয়। মননের জানালাগুলো বন্ধ হয়ে আছে বহুদিন। কংক্রিটের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আধুনিকতার মিথ্যা সাজ, আর তার আড়ালে নিঃশব্দে মরছে প্রজ্ঞা, যুক্তি আর মানবিকতা।

দুই হাজার বছর আগে এরিস্টটল মানবসভ্যতার জন্য ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কিছু কালজয়ী বাণী—জ্ঞান, নৈতিকতা, রাজনীতি ও মানব চরিত্রের গভীরতম শিক্ষা। কিন্তু আজকের ঢাকার বাস্তবতায় সেই বাণীগুলো যেন অচল মুদ্রার মতো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে আছে।

নিচে সেই ছয় বাণীকে ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করা হলো।

. জ্ঞানতত্ত্বের করুণ পরিণতি: যখন সত্যের চেয়ে গুজবই বেশি প্রিয়

এরিস্টটল  বলেছিলেন, দার্শনিক বলেছিলেন: All human beings by nature desire to know (জন্মগতভাবেই মানুষ জ্ঞানলিপ্সুএই সত্য আজ ঢাকায় ক্রমে মৃতপ্রায়।)

হায় রে জ্ঞান! এরিস্টটল হয়তো জানতেন না যে, তাঁর এই আকাঙ্ক্ষাকে নিশ্চুপ করার জন্য এই সমাজে তথ্য অধিকার আইন তৈরি হবে, যা কাগজে-কলমে মানুষকে অধিকার দেবে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তির মতো গুরুগম্ভীর বিষয়গুলিতে মানুষকে রাখা হবে চির-অন্ধকারে। আর সেই অন্ধকারের সুযোগে, মানুষ কষ্ট করে সত্য যাচাই করতে আর আগ্রহী নয়। বরং, তারা ভেসে চলে জুকারবার্গের বিশেষ বই (ফেসবুক) নামক সেই মায়াবী চোরাবালিতে— যেখানে গুজবের ভরা জোয়ার। এখানে যে যাই বলুক না কেন, তার পক্ষে-বিপক্ষে তর্কের লোকের অভাব হয় না। ভার্চুয়াল জগতে সবাই নিজেকে 'বিশেষ অজ্ঞ' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, সারাক্ষণ তুচ্ছ বিষয়ে ঝড় তুলছে। এরিস্টটলের জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা আজ কেবলই 'লাইক' পাওয়ার তাড়নায় পর্যবসিত।

একসময় মানুষ জানার জন্য পুস্তক খুলত, আর আজ মানুষ যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফেসবুক স্ক্রল করে। তথ্য অধিকার আইন আছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় তথ্যের অন্ধকার গহ্বরে সাধারণ মানুষ সবসময়ই বাইরে। মানুষ এখন আর সত্যের খোঁজে ঘাম ঝরায় না—বরং অন্যের মুখে শোনা গুজবই মুখে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর এদিকে মার্ক জাকারবার্গের সোশ্যাল মিডিয়া যেন নতুন এক ‘অজ্ঞতার বিশ্ববিদ্যালয়’। সবাই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, অথচ সত্যের সামনে দাঁড়ালে হাঁটু কাঁপে। “যা শুনে মন চায়, সেটাই সত্য”—এই দর্শনেই যেন আজকের জ্ঞানচর্চা সীমাবদ্ধ।

এরিস্টটল হয়তো ভাবতেও পারেননি—মানুষ জ্ঞান চায় ঠিকই, কিন্তু পরিশ্রম ছাড়া জ্ঞান নয়, বরং গুজবের আরামে ভাসা

জ্ঞান অর্জনের স্বভাব আজ ঢাকায় গুজবের বাজারে হারিয়ে গেছে। মানুষ নাকি স্বভাবতই জ্ঞান-পিপাসু। কিন্তু আজকের ঢাকা যেন গুজব-পিপাসু। টঙ্গীর এক সরকারি দপ্তরের সামনে চায়ের দোকানে আমি দেখেছিলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য—চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে তর্ক করছেন দেশের আর্থিক সংকট নিয়ে। কেউই জানেন না আসল তথ্য কী, কিন্তু প্রত্যেকেই বিশেষজ্ঞের ভঙ্গিতে কথা বলছেন। আমার পাশের এক বৃদ্ধ হেসে ফিসফিস করে বললেন—বাবা, এখানকার মানুষ সত্যের জন্য ঘেমে যায়, গুজবের জন্য নয়। ফেসবুকই এখন বিশ্ববিদ্যালয়।

এখন তথ্য অধিকার আইন আছে, কিন্তু নির্দিষ্ট তথ্যের অন্ধকার গহ্বরে সাধারণ মানুষ আজও বন্দি। সত্যের প্রতি আকর্ষণ কমেছে, আরামপ্রিয় ‘শোনা কথা’তে ভাসাই যেন এখন উত্তেজনার খোরাক।

এরিস্টটল হয়তো ভাবতেই পারেননি—মানুষ একদিন জানার আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ‘লাইক-শেয়ারের আকাঙ্ক্ষা’তে ডুবে যাবে।

. রাজনৈতিক সত্তার বিকৃতি: যখন 'আমিত্ব' হয়ে ওঠে একমাত্র মন্ত্র

এরিস্টটলের আরেক মহান উক্তি: “Man is by nature a political animal (মানুষ স্বভাবতই এক রাজনৈতিক সত্তা)

ঢাকায় এই বাণী বিকৃত হয়ে হয়েছে—“সবাই রাজনীতিবিদ, কিন্তু কেউ নাগরিক নয়।”এ শহরে রাজনীতি যেন ছায়ার মতো লেগে থাকে মানুষের মনে। বিশেষ করে তরুণদের একাংশ রাজনীতিকে দেখে ‘অস্তিত্বের সার্টিফিকেট’ হিসেবে। এরিস্টটল যাকে বলেছিলেন সামাজিক অগ্রগতির চালিকা শক্তি, তা আজ অনেকের কাছে হয়ে গেছে দম্ভ, উগ্রতা ও আমিত্ব প্রদর্শনের মঞ্চ।

এই বাণীটিকে এই জনপদের মানুষ যেন চরম গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে! তবে গ্রহণ করেছে বিকৃত রূপে। এই দেশে অধিকাংশেরই আজ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু রাজনীতি— যেখানে 'রাজনৈতিক সত্তা' হয়ে ওঠার অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা কল্যাণের জন্য নয়, বরং আমিত্বের জয়গান গাওয়ার জন্য। এখানে রাজনীতি আর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা নয়, বরং একটি 'পার্টির কৃতদাস' হিসেবে নিজেকে জাহির করার নিরন্তর প্রতিযোগিতা। মানুষ রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না করে, বরং ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যেই যেন জন্ম নিয়েছে।

ক্লাসরুমে, চায়ের দোকানে, ফুটপাতের আড্ডায়—প্রত্যেকে রাজনীতি বোঝে, কিন্তু রাজনৈতিক নৈতিকতা? সে তো বহু আগেই উধাও। এরিস্টটল মানবিক, যুক্তিবাদী, সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক সত্তার কথা বলেছিলেন। ঢাকায় রাজনৈতিকতা মানুষের চরিত্র নয়—ব্যক্তিত্বের বিজ্ঞাপন। এরিস্টটল বলেছিলেন, মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক সত্তা। কিন্তু আজ ঢাকায় রাজনীতি হয়ে গেছে চেহারা দেখানোর সর্বোচ্চ মঞ্চ

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ তার প্রোফাইলে লিখেছে—রাজনীতিই আমার পরিচয়। পরিচয়ের পাশে একটি বড়সড় ছবি—দলের পতাকা উড়ছে। রাজনীতি এখন আর সমাজ গড়ার শক্তি নয়, বরং হাহাকার, দম্ভ আর দখলবাজির প্রতিযোগিতা

একজন রিকশাচালক বলেছিলেন— ভাই, এখন কেউ রাজনীতি করে না, সবাই পদের রাজনীতি করে। ঢাকা তাই রাজনৈতিক স্বভাবের নয়—রাজনৈতিক সাজের শহর। ঢাকা বরং জন্ম দিয়েছে “চেনো আমাকে?” সংস্কৃতি।

. শিক্ষার তেতো শিকড়: জ্ঞানের চেয়ে অর্থের প্রতি তীব্র ঝোঁক

এরিস্টটল বলেছিলেন:  “The roots of education are bitter, but the fruit is sweet (শিক্ষার শিকড় তিতা, কিন্তু তার ফল অতিশয় মিষ্টি)

কিন্তু এই সমাজে তেতো জিনিস, যতই পুষ্টিকর হোক না কেন, তা মুখরোচক নয়। রসনাবিলাসের সহায়ক নয়। আর তাই শিক্ষার এই 'তেতো শিকড়'-কে যেন রাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবেই অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিয়েছে। যখন রাষ্ট্র সংস্কারের মহাযজ্ঞ চলে, তখন শিক্ষা ব্যবস্থা ধুলোয় ঢাকা পড়ে থাকে সংস্কারের অন্তরালে। এরিস্টটল হয়তো তাৎক্ষণিক সুখের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদী জ্ঞানের মূল্য বোঝাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিধি বাম!

ঢাকায় শিক্ষার শিকড় আজ তিতা নয়—অপ্রয়োজনীয়।এই সমাজ তেতো জিনিস মুখে তুলতেই নারাজ—তা সে ঔষধ হোক কিংবা শিক্ষা। জ্ঞানের তেতো শিকড় বয়ে নিয়ে যাওয়ার ধৈর্য এখন আর কারও নেই। সবাই ফল চায়, কিন্তু শ্রম নয়।

এক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা এখানে উদাহরণ হিসেবে আসে। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন: "তোমাদের সামনে যদি এক হাতে সমস্ত জ্ঞানের ভান্ডার আর অন্য হাতে ধন-দৌলত থাকে, তোমরা কোনটি নেবে?" সকল শিক্ষার্থী সমস্বরে উত্তর দিল— ধন-দৌলত! হতাশ শিক্ষক যখন বললেন যে তিনি জ্ঞান নিতেন, তখন এক ছাত্রের প্রত্যুত্তরে বলল—স্যার, মনে কইরেন নাযার যা অভাব সেও তো তাই চাইবে। জ্ঞানের অভাবের কষ্ট কেউ টের পায় না, টের পাওয়া যায় টাকার অভাব।একটু বিরতি দিয়ে আবার সে বলল: "স্যার, এটাই সমাজের রীতি। যার যা অভাব, সে তো তাই নিতে চাইবে!" এই উত্তর যেন প্রমাণ করে দেয়, জ্ঞান আজ এই সমাজে কতটা দুষ্প্রাপ্য, আর অর্থের অভাব কতটা প্রবল! আর জনাব এরিস্টটল যদি শুনতেন—বোধহয় দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।:

ঢাকায় শিক্ষার তেতো শিকড় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে দ্রুতফলের আশায়। সত্যি, শিক্ষার তেতো শিকড় সহ্য করার মতো ধৈর্য আজ আমাদের সমাজে নেই। জ্ঞান নয়, আমরা চাই সার্টিফিকেট। চিন্তা নয়, চাই চাকরি। নৈতিকতা নয়, চাই অবস্থান। এরিস্টটল যে দীর্ঘমেয়াদী মিষ্টি ফলের কথা বলেছিলেন—ঢাকায় কেউ তার স্বাদ নিতে অপেক্ষা করতে চায় না।

. মধ্যবিত্তের করুণা: আদর্শের ধ্বজাধারী, লুটেরাদের ভরসা

দার্শনিকের বিশ্বাস ছিল:  “The best political community is formed by citizens of the middle class (সর্বোত্তম রাজনৈতিক সমাজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকদের দ্বারাই গঠিত হয়)

ঢাকায় মধ্যবিত্ত আজ রাজনৈতিক শক্তির মেরুদণ্ড নয়—বরং কাঁধে ঝোলানো বোঝা।মধ্যবিত্তেরা সবচেয়ে বেশি অভাব দেখে, সবচেয়ে বেশি লড়াই করে, তবু সবচেয়ে কম শোনা হয়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, আয়ের অনিশ্চয়তা—সবচেয়ে বেশি আঘাত করে তাদের বুকে।

আসলে কিন্তু এই দেশে মধ্যবিত্তের জীবনটাই সবচেয়ে বড় বিপদসংকুল কাব্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর অভাব-অনটনে তারা কারো কাছে হাত পাততে পারে না— তারা যেন সেই সৈয়দ বংশের পোলা, যারা চুরি করতে পারে, কিন্তু ভিক্ষা করতে পারে না! এই মধ্যবিত্তরাই যখন সুযোগ পায়, তার অধিকাংশই সদ্ব্যবহার করে। সমাজে ক্রমবর্ধমান উচ্চশ্রেণীর চরমপন্থালুটেরাদের দাপট টিকিয়ে রাখার জন্য এই মধ্যবিত্তরাই আজ যেন ভরসার খুঁটি হয়ে আছে। এরিস্টটল যে আদর্শ সমাজের ভিত্তি হিসেবে মধ্যবিত্তকে দেখেছিলেন, আজকের মধ্যবিত্তের হাতে সেই আদর্শই যেন বিপন্ন।

তবু এদেরই বলা হয় সমাজের বিবেক। কারণ মধ্যবিত্তই লোভ ও লুটের দুই মেরুর মাঝে দাঁড়িয়ে ঢাকাকে টিকিয়ে রাখে। এরিস্টটল বলেছিলেন—মধ্যবিত্ত সমাজই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। কিন্তু ঢাকায় মধ্যবিত্তেরা বরং হাওয়া অফিসের বাতাসে দুলে ওঠে—সহ্য করে, বাঁচে, আবারও সহ্য করে।

ঢাকায় উৎকর্ষের অভ্যাস নেই—ভান করার অভ্যাস আছে। উৎকর্ষের অভ্যাস? — ঢাকায় তা এখন ‘পুরোনো কালের কথা’। এ শহরে মানুষ বারবার যা করে—মিথ্যে গল্প, আপ্যায়নের মুখোশ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি—এসবই যেন এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

এক সরকারি দপ্তরে গেলেই দেখা যায়—ফাইল সরাতে হবে, সিল দিতে হবে; কিন্তু ‘চা-নাস্তা’ না হলে কাজ আগায় না। এ যেন উৎকর্ষ নয়—‘অভ্যাসের উৎকর্ষ’। এরিস্টটল বলেছিলেন—উৎকর্ষ হলো অভ্যাসগত চরিত্র। ঢাকায় যেন অভ্যাসগত দুর্বলতাই চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

. উৎকর্ষের কফিন: যখন অভ্যাস কেবলই দুর্নীতির নামান্তর

এরিস্টটলের অমোঘ বাণী: “We are what we repeatedly do. Excellence is a habit ("আমরা তাই, যা আমরা বারবার করি। অতএব, উৎকর্ষ কোনো কাজ নয়, এটি একটি অভ্যাস)

এই উক্তিটি আজকের অধিকাংশ বাঙালির ক্ষেত্রে এক ভিন্ন অর্থ বহন করে। আমিত্বের বলে বলীয়ান হয়ে কৃত্রিমতার ঢঙে নিজেকে উপস্থাপন করাই যেন এক শৈলী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাইতো বাংলায় প্রবাদ এসেছে: "উপরে দিয়ে ফিটফাট, ভিতর দিয়ে সদরঘাট।" এই এক প্রকার আত্মপরিচয়ের হীনম্মন্যতা থেকেই মানুষ যখনই সুযোগ পেয়েছে, উজাড় করে দিতে চেয়েছে নিজের হাতে। ফলে, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এবং অনিয়ম আজ তাদের কাছে আর খারাপ কাজ নয়, বরং 'ডালভাত' বা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এরিস্টটলের এই বাণী এখন আর নৈতিকতার উৎকর্ষ ব্যাখ্যা করে না, বরং এই সমাজের নৈতিকতার পতনকেই ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে।

আজকের ঢাকায় ‘অভ্যাস’ এখন নৈতিকতার নয়—নকল, ভান, দুর্নীতির। এরিস্টটল বলেছিলেন—সতত অভ্যাসই মানুষকে উৎকৃষ্ট করে তোলে। ঢাকায় অভ্যাস বলতে— ফাঁকিবাজি; অপকর্ম; স্বজনপ্রীতি; আর দুর্নীতি—এগুলোই ‘স্বাভাবিকতা’। এখানে মানুষ নিজেকে উপস্থাপন করে ‘ফিটফাট’, অথচ ভিতরে সদরঘাট। এই তফাতই যেন আজকের পরিচয়ের মাপকাঠি। উৎকর্ষ নয়, বরং দেখানো উৎকর্ষই এখন অভ্যাস। এরিস্টটলের বাণী যেন এখানে এসে দাঁড়িয়েছে—“উৎকর্ষের অভ্যাস নেই, ভান করার অভ্যাসই যথেষ্ট।”

ঢাকায় উৎকর্ষের অভ্যাস নেই—ভান করার অভ্যাস আছে। উৎকর্ষের অভ্যাস? — ঢাকায় তা এখন ‘পুরোনো কালের কথা’। এ শহরে মানুষ বারবার যা করে—মিথ্যে গল্প, আপ্যায়নের মুখোশ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি—এসবই যেন এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এক সরকারি দপ্তরে গেলেই দেখা যায়—ফাইল সরাতে হবে, সিল দিতে হবে; কিন্তু ‘চা-নাস্তা’ না হলে কাজ আগায় না। এ যেন উৎকর্ষ নয়—‘অভ্যাসের উৎকর্ষ’। এরিস্টটল বলেছিলেন—উৎকর্ষ হলো অভ্যাসগত চরিত্র। ঢাকায় যেন অভ্যাসগত দুর্বলতাই চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

. সমালোচনার মৃত্যু: যখন বোবাই হয় সর্বেসর্বা

এরিস্টটলের শিক্ষিত মনের সংজ্ঞা ছিল: It is the mark of an educated mind to entertain a thought without accepting it (শিক্ষিত মনের পরিচয় হলো, কোনো চিন্তাকে গ্রহণ না করেও তাকে বিবেচনা করতে পারা)

কিন্তু হায়! এরিস্টটল হয়তো জানতেন না, এই সমাজে সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এই কাজটি এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখানে কেউ সমালোচনা বা 'ক্রিটিসিজম' নিতে পারে না। আপনি রাজনীতি করেন, আর দলীয় প্রধানের সমালোচনা করেন? দলের পদ হারানো নিশ্চিত। সরকারের বিপক্ষে লিখবেন? আপনার স্থান হবে জেলখানায়। তাইতো এদেশের সমাজ বাস্তবতায় প্রবাদ এসেছে: "বোবার কোনো শত্রু নাই।" এই পরিস্থিতি যেন সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking)-এর অভাবকে স্বাগত জানিয়ে অন্ধ অনুসরণের এক সর্বব্যাপী প্রক্রিয়া চালু করেছে। এরিস্টটলের শিক্ষিত মনের আদর্শ এই সমাজে ঠাঁই না পেয়ে নির্বাসিত হয়েছে।

আজকের ঢাকা—বিপরীত মত সহ্য করতে পারে না। একসময় মানুষ চিন্তা শুনত, বিশ্লেষণ করত, তারপর সিদ্ধান্ত নিত।
আজকের ঢাকা? সমালোচনার নাম শুনলেই মানুষ আহত হয়—দল হোক, ক্ষমতা হোক, ব্যক্তি হোক। রাজনীতিবিদ দলের প্রধানকে প্রশ্ন করতে পারে না। লেখক সরকারের বিরুদ্ধে লিখলে জবাব আসে মামলায় বা কারাগারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মত দিলে বিরুদ্ধপক্ষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে দেশে একটি নতুন প্রবাদ দানা বেঁধেছে—বোবার কোনো শত্রু নেই। এখানেই শেষ এরিস্টটলের স্বপ্ন—যে সমাজে চিন্তা গ্রহণ না করেও বিবেচনা করার মানসিকতা থাকে। আজকার সমাজ বরং অন্ধ অনুসরণকে উৎসাহ দেয়, আর সমালোচনাকে দেখে ‘অপরাধ’ হিসেবে।

চিন্তা গ্রহণ না করেও বিবেচনা করার যে ক্ষমতা—ঢাকায় তা আজ বিলুপ্তপ্রায়। ঢাকায় কেউ যদি কোনো মত দেয়, তৎক্ষণাৎ দুই পক্ষ তৈরি হয়—এক পক্ষ ‘মাটি ধরো’। অন্য পক্ষ ‘মান-ইজ্জত নষ্ট করো’।

এখানে কাউকে সমালোচনা করা মানেই শত্রুতা। দলীয় প্রধানকে প্রশ্ন করলে পদ হারানো নিশ্চিত। অফিসে বসকে প্রশ্ন করলে বদলি। অনলাইনে সরকারের বিরুদ্ধে লিখলে মামলা। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলেছিল—স্যার, এই দেশে চিন্তা করলে সমস্যা, চিন্তা না করলে নিরাপত্তা।

সমালোচনামূলক মনন যেখানে অপরাধ, সেখানে এরিস্টটলের বাণী কেবলই বইয়ের পাতার ‘জবা ফুল’—দেখতে সুন্দর অথচ ছোঁয়া যায় না।

শেষ কথা

এরিস্টটল এমন এক পৃথিবীর কথা ভেবেছিলেন, যেখানে মানুষ জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত, নৈতিকতায় দৃঢ়, চিন্তায় উদার, সমাজে মধ্যবিত্তের বিবেকময় শাসন থাকবে। ঢাকা সেই পৃথিবী থেকে যতটা দূরে সরে এসেছে—তা হয়তো এরিস্টটল নিজেও বুঝতে পারতেন না। আজ তার বাণীগুলো পুস্তকে শোভা পায়, বন্ধীশালায় আবদ্ধ থাকার মতো। এ যেন বাঙালীর আরেক বিখ্যাত প্রবাদেরই পুনরাবৃত্তি— “কাজীর গরু গোয়ালে নয়, কিতাবে রয়।”

চূড়ান্ত প্রতিফলন

এরিস্টটল আজ ঢাকায় এলে কী বলতেন?

হয়তো তিনি দাঁড়িয়ে বলতেন—“তোমরা জ্ঞানকে ভুলে গিয়েছ, রাজনীতিকে বিকৃত করেছ, শিক্ষাকে অবজ্ঞা করেছ, মধ্যবিত্তকে শোষেছ, নৈতিকতাকে অভ্যাসে পরিণত করোনি, আর চিন্তার স্বাধীনতাকে হত্যা করেছ।”

শহর জেগে আছে—কিন্তু জ্ঞানের আলো নিভে গেছে।
শব্দ আছে—কিন্তু মননের নীরবতা অনুভূত হয়।
চলাফেরা আছে—কিন্তু ভাবনার মৃত্যু ঘটেছে।

এটাই আধুনিক ঢাকার ট্র্যাজেডি—

এরিস্টটলের ছয়টি চিরন্তন সত্য আজ মানুষের জীবনে নেই;
 সেগুলো আজ শুধু দেওয়ালে টাঙানো পোস্টার—
 সাজানোর জন্য, মানার জন্য নয়।

✍️ অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

 

#ঢাকারসমাজ #এরিস্টটল #BangladeshReality #PhilosophyAndSociety
#EducationCrisisBD #MiddleClassStruggle #PoliticalCultureBD
#CriticalThinking #DhakaFeature #SocialAnalysis #ThoughtLeadership
#BangladeshSociety #KnowledgeCrisis #AristotleRevisited



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: