—একটি রম্য রচনা
“ধরিস না, ভরিস না, মারিস না”—এই বিখ্যাত সংলাপকে রূপক করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দ্বিচারিতা, পোস্ট-ফ্যাক্টো নেতৃত্ব, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনীতির অন্তর্গত সহিংস সংস্কৃতি ও আইনের শাসনের সংকট নিয়ে একটি গভীর রম্য ও ব্যঙ্গাত্মক ফিচার বিশ্লেষণ।
একটি স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘর। বাইরে অস্থির এক সময়, রাজপথে স্লোগান আর বারুদের গন্ধ। একদল যুবক একজনকে প্রায় পাঁজাকোলা করে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল। দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন এক ‘মুরুব্বি’। তার টাক মাথা কোট পেন্ট পড়া ভদ্রলোক আর চশমার ফ্রেমের পেছনে লুকিয়ে থাকা চোখগুলো যেন অনেক অভিজ্ঞতার সাক্ষী। ভরাট এবং গম্ভীর গলায় তার নির্দেশ ভেসে এল— “ধরিস না, ভরিস না, মারিস না!”
মুরুব্বি প্রশ্ন করলেন, “কে এটা?” উত্তর এল, “মক্কেল!” “করেছে কী?” মুরুব্বির দ্বিতীয় প্রশ্ন। যুবকদের একজনের তড়িৎ এবং ক্ষুব্ধ জবাব, “ওস্তাদ! আমাদের বিরোধী দল করে। এতদিন আমাদের ওপর জুলুম করেছে, আজ সুযোগ পেয়েছি।”
মুরুব্বি তখন নির্দেশ দিলেন তাকে পাশের রুমে নিয়ে যেতে। নির্দেশের রেশ কাটতে না কাটতেই পাশের ঘর থেকে ভেসে এল সপাং সপাং শব্দের সাথে গগনবিদারী আর্তনাদ। মুরুব্বি আবার হুংকার দিলেন, “ধরিস না!” কিন্তু ততক্ষণে কাজ শুরু হয়ে গেছে। ভেতর থেকে উত্তর এল, “ভরে দেই তারে! এর শোধ তোলা দরকার।” মুরুব্বি বললেন, “ভরিস না!” কিন্তু ততক্ষণে মাইর শুরু হয়ে গেছে। মুরুব্বি আবারও বললেন, “মারিস না!”
এই দৃশ্যটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার বর্ণনা নয়; এটি যেন আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এক নিখুঁত রূপক প্রতিচ্ছবি। এখানে যা বলা হচ্ছে, তা ঘটছে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। অনেকটা ‘কাজ শেষে কাজি’ সাজবার মতো। কাগজে-কলমে যা লেখা আছে, বাস্তবে ঘটছে তার ঠিক উল্টো। এই যে এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা—প্রশ্ন জাগে, নাগরিক হিসেবে এই দোলাচলের মধ্যে আমাদের অবস্থান কোথায়? আর এই খেলা চলবে কতদিন?
বই বনাম বাস্তব: এক জটিল ধাঁধা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটা যেন এক অতি পরিচিত অথচ সমাধানহীন ধাঁধা। পাঠ্যপুস্তকে বা সংবিধানের পাতায় এর ছবিটা আকাশচুম্বী পাহাড়ের মতো সুন্দর এবং মহিমান্বিত। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা—গণতন্ত্রের আলো, আইনের শাসন, আর সাম্যের সুবর্ণ প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধে যখন আমরা বইয়ের পাতা থেকে বাস্তবের কর্দমাক্ত মাটিতে পা রাখি।
সংবিধানে বলা আছে, আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কেউ কেউ আইনের চেয়ে একটু বেশিই ‘সমান’। সংবিধানে লেখা আছে সুবিচারের কথা, অথচ আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা মাঝে মাঝে এতটাই সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে যে মনে হয়—আমরা কি আসলেই একই দেশে বাস করছি? সংবিধানে যেখানে নাগরিকের বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেখানে বাস্তবে কথা বলার আগে চারপাশ দেখে নিতে হয়। যেখানে পুলিশকে বলা হয়েছে জনগণের বন্ধু, সেখানে মানুষ পুলিশ দেখলেই তটস্থ হয়ে ওঠে। এই যে ছবিটা কেমন পিছল হয়ে যাচ্ছে, এটাই আমাদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা।
‘মুরুব্বি’ ও নির্দেশনার রাজনীতি
আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে ‘মুরুব্বি’ বা নেতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই নেতৃত্বের নির্দেশগুলো প্রায়শই আসে ঘটনার পরে। যখন কোনো গণপিটুনির ঘটনা ঘটে যায়, যখন কোনো স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়, কিংবা যখন ক্ষমতার পালাবদলে প্রতিশোধের নেশা মত্ত হয় জনতা—তখন নেতৃত্বের পক্ষ থেকে হুংকার আসে, “আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।”
কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে। ‘মক্কেল’কে ধরা হয়েছে, তাকে ‘ভরে দেওয়া’ হয়েছে এবং চূড়ান্ত ‘মার’ শুরু হয়ে গেছে। এই যে ‘পোস্ট-ফ্যাক্টো’ বা ঘটনা পরবর্তী নির্দেশ, এটা কি আসলেই আইন মানার আহ্বান নাকি স্রেফ রেকর্ড রাখার কৌশল? রাষ্ট্র যখন অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয়, তখন জনতার এই উগ্র রূপটি ফুটে ওঠে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি শুরুতেই নিশ্চিত করতে পারত যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তবে মুরুব্বির এই আর্তচিৎকারের প্রয়োজন হতো না।
ফ্যাসিবাদ ও প্রতিশোধের মনস্তত্ত্ব
আমাদের সংলাপের মূলে ছিল ‘বিরোধী দল করে’—এই অভিযোগ। গত কয়েক দশকে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি আমাদের রাজনৈতিক অভিধানে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। যখন কোনো শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চায় এবং ভিন্নমতকে দমন করে, তখনই তাকে আমরা ফ্যাসিস্ট বলি। কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো, ফ্যাসিবাদকে হঠাতে গিয়ে আমরা কি নিজেরাই আরেক ধরণের ছোট ছোট ফ্যাসিবাদের জন্ম দিচ্ছি না?
পাশের রুমে নিয়ে মারার যে সংস্কৃতি, তা ফ্যাসিবাদকেই পুষ্ট করে। মুরুব্বি যখন বলেন ‘ধরিস না’, অথচ তার অনুসারীরা ‘ভরে দেয়’, তখন বোঝা যায় নেতৃত্বের ওপর মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ নেই। অথবা এমনও হতে পারে, নেতৃত্বের মৌন সম্মতিতেই এই কাজগুলো ঘটছে। এই দ্বিমুখী আচরণ রাষ্ট্রকে একটি স্থিতিশীল কাঠামোর পরিবর্তে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইটা কেবল ব্যক্তি পরিবর্তনের নয়, তা হওয়া উচিত সংস্কৃতির পরিবর্তনের।
আইন সবার জন্য, রাস্তা সমান সকলের!
একটি সভ্য রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হলো সাম্য। রাস্তার ডিভাইডারের ওপর দিয়ে দামি গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ যেমন কারো নেই, তেমনি রাজনৈতিক পরিচয়ের দোহাই দিয়ে কাউকে বিনা বিচারে সাজা দেওয়ার অধিকারও কারো নেই। কিন্তু আমাদের দেশে ‘রাস্তা’ বা ‘সুযোগ’গুলো সবার জন্য সমান নয়। একদল লোক সবসময় ভিআইপি লেনে চলতে অভ্যস্ত, তা হোক রাজপথে কিংবা বিচারালয়ে।
আমরা আজ একা নই। আমরা সবাই মিলে বলতে চাই—আইন সবার জন্য এক হতে হবে। যদি কেউ ফ্যাসিস্ট হয়, তবে তার বিচার হবে আদালতে, অন্ধকার ঘরে নয়। যদি কেউ অপরাধী হয়, তাকে আইনের আওতায় এনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শাস্তি দিতে হবে। যখন একজন সাধারণ নাগরিক দেখবে যে প্রভাবশালী ব্যক্তিটিও অপরাধ করে পার পাচ্ছে না, তখনই রাষ্ট্রের প্রতি তার আস্থা ফিরবে। “আইন সবার জন্য, রাস্তা সমান সকলের!”—এই স্লোগানটি কেবল রাজপথের নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের হৃদয়ের দাবি হওয়া উচিত।
গণতন্ত্র কি কেবলই ব্যালট বাক্স?
আমাদের দেশে গণতন্ত্রকে অনেক সময় স্রেফ ভোটের সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করা হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল প্রাণ হলো চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস (ভারসাম্য)। যেখানে মুরুব্বি বা নেতা বললেই সব হবে না, বরং প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে নিজস্ব গতিতে চলা। যখন মুরুব্বি চিৎকার করে বলবেন “মারিস না”, তখন তার নির্দেশের দরকার পড়বে না কারণ পুলিশ এবং বিচার বিভাগ ততক্ষণে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে।
গণতন্ত্র মানে হলো সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতাবলম্বীদের নিরাপত্তা। গণতন্ত্র মানে হলো প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘বিজয়’ মানেই হলো অন্য পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লাইসেন্স। এই সংস্কৃতি যতদিন না বদলাচ্ছে, ততদিন মুরুব্বির কণ্ঠ ভরাট হলেও তা অরণ্যে রোদন হিসেবেই থেকে যাবে।
আমাদের আশা: এবার কি মিলবে সব?
আমরা এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। তরুণ সমাজ নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। যে বাংলাদেশে ‘মক্কেল’ ধরে এনে পাশের রুমে নিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি থাকবে না। যে বাংলাদেশে মুরুব্বিকে বলতে হবে না ‘ধরিস না’, কারণ কেউ বেআইনিভাবে কাউকে ধরবে না। আমাদের আশা—ন্যায়বিচার এবার কোনো ব্যক্তি বা দলের মুখাপেক্ষী হবে না।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটা যেন এক জটিল ধাঁধা হয়ে না থাকে। বইয়ের পাতায় যেমন ঝকঝকে সাম্যের ছবি, আমরা চাই বাস্তবেও সেই আলোর প্রতিফলন হোক। আমরা চাই না দুটো ভিন্ন দেশে বাস করতে—একটি সংবিধানের বাংলাদেশ, অন্যটি অন্ধকারের বাংলাদেশ। আমরা চাই এক ও অনন্য বাংলাদেশ, যেখানে আইনের শাসন হবে ধ্রুব সত্য।
শেষ কথা
“ধরিস না, ভরিস না, মারিস না”—মুরুব্বির এই সংলাপগুলো যেন আমাদের বিবেকের দংশন। আমরা কি আসলেই অপরাধীকে শাস্তি দিতে চাই, নাকি আমরা স্রেফ আমাদের ক্ষোভ মেটাতে চাই? যদি ক্ষোভ মেটানোই লক্ষ্য হয়, তবে আমরা সেই ফ্যাসিবাদকেই ফিরিয়ে আনছি যাকে আমরা হঠাতে চেয়েছি।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই ধাঁধার সমাধানের ওপর। লেখা আছে যা, তার উল্টোটা হওয়া বন্ধ করতে হবে। নেতৃত্বের হুংকার যেন স্রেফ লোক দেখানো না হয়, তা যেন হয় কার্যকর অঙ্গীকার। রাস্তা সমান করার কাজটা আজ থেকেই শুরু হোক। কারণ আইন যখন সবার জন্য সমান হয়, তখনই সমাজ থেকে ঘৃণা ও প্রতিহিংসা বিলুপ্ত হয়। আর তখনই আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারব—আমরা একটি গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে বাস করি।
বিজয় তখনই সার্থক হবে, যখন পাশের ঘর থেকে আর কোনো কান্নার শব্দ ভেসে আসবে না। যখন মুরুব্বি হাসিমুখে বলতে পারবেন, “ছেড়ে দে, আইন তার ব্যবস্থা নেবে।” সেই ভোরের অপেক্ষায় আমরা সবাই।
✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#ধরিসনা #ভরিসনা #মারিসনা #BangladeshPolitics #StateSystemBD #RuleOfLaw #PoliticalSatire #JusticeForAll #Gonotontro #AntiFascism #CivilRightsBD #OdhikarPatra #BanglaFeature #ProtestCulture

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: