odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Monday, 29th December 2025, ২৯th December ২০২৫
ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, দ্বৈত শিক্ষাব্যবস্থা ও মানসিক বিচ্ছিন্নতার ফাঁদে বাংলাদেশে শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার দীর্ঘস্থায়ী সংকটের এক বিশ্লেষণধর্মী আখ্যান —Education in this country is like a river... sometimes stuck in a dry channel.

ভাঙা মন, বিচ্ছিন্ন শিক্ষা: বাংলাদেশে যুগযুগান্তরের শিক্ষা–সংকট ও উচ্চশিক্ষার বেহাল বাস্তবতা

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ২৯ December ২০২৫ ০৩:১১

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ২৯ December ২০২৫ ০৩:১১

-উপসম্পাদকীয়

বাংলাদেশে শিক্ষা সংকট কেবল পাঠ্যক্রমের সমস্যা নয়—এটি ভাষা, মনন, সংস্কৃতি ও নীতির সংকট। ঔপনিবেশিক শিক্ষা উত্তরাধিকার থেকে দ্বৈত শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষিত বেকারত্ব ও উচ্চশিক্ষার গুণগত অবনতির মধ্য দিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশার এক গভীর বিশ্লেষণ।

নদীর মতোই এ দেশের শিক্ষা—কখনো প্রবাহমান, কখনো শুকিয়ে যাওয়া খাতে আটকে থাকা। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডে জ্ঞানচর্চা ছিল সমাজের প্রাণশক্তি, আবার সেই জ্ঞানই এক সময় হয়ে উঠেছে বিচ্ছিন্নতার উৎস, সংকটের কারণ, আর উচ্চশিক্ষায় পৌঁছে এক গভীর হতাশার নাম। শিক্ষা এখানে কেবল পাঠ্যসূচি নয়, এটি মানসিকতা, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ক্ষমতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘ আখ্যান।

বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষা কখনো মুক্তির পথ, কখনো সংকটের নাম। এই ভূখণ্ডে জ্ঞানচর্চা একদিন ছিল সমাজের প্রাণস্পন্দন—পাঠশালা, মক্তব, টোল, খানকা কিংবা আড্ডাভিত্তিক বিদ্যাচর্চা মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বাভাবিক যোগসূত্র ক্রমে ছিন্ন হয়েছে। আজ আমরা এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে শিক্ষা আছে, ডিগ্রি আছে, প্রতিষ্ঠান আছে—কিন্তু জীবনের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক দুর্বল, আর উচ্চশিক্ষা পৌঁছে গেছে গভীর এক বেহাল দশায়।

এক সময় গ্রামের পাঠশালায়, মক্তবে কিংবা টোলে শিক্ষা ছিল জীবনেরই অংশ। জীবন থেকে শিক্ষা আলাদা ছিল না। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার চরিত্র বদলে যেতে শুরু করল। কাজী আবদুল ওদুদের ভাষায়, “আমাদের দেশের আধুনিক চিত্ত যে কত বিশৃঙ্খলাপূর্ণ”—তার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় শিক্ষার দিকে তাকালে। যে ভাষা আমাদের মাতৃভাষা নয়, সেই ভাষার বাহনে শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে জন্ম নেয় এক গভীর দ্বন্দ্ব, সৃষ্টি হয় দ্বিধা ও বিচ্ছিন্নতা। ভাষা বদলায়, কিন্তু মন বদলায় না। মন বদলায় না বলেই শিক্ষা কেবল মুখস্থ বিদ্যা হয়ে ওঠে, চরিত্রগঠন বা বুদ্ধির উৎকর্ষ সাধন তার নাগালের বাইরে থেকে যায়। এ কথা মনে রাখা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষাল মাধ্যম হিসেবে ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি চিন্তার বাহন। বাহনই যদি স্বাভাবিক না হয়, তবে চিন্তার গতি ব্যাহত হবেই।

কিন্তু সমস্যাটি শুধু ভাষার নয়। ভাষা বদলালেই যে শিক্ষা বদলে যাবে—এমন সরল সমীকরণ বাস্তবে কাজ করে না। কারণ শিক্ষা দান ও গ্রহণের সঙ্গে জড়িত মানুষের মন যদি আড়ষ্ট, বিভক্ত ও দোদুল্যমান হয়, তবে সবচেয়ে সুন্দর পাঠ্যক্রমও কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারে না। এই আড়ষ্টতা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে শিক্ষকদের মধ্যেই—যাঁরা সমাজের দিশারি হওয়ার কথা, অথচ নিজেরাই দ্বিধা, দারিদ্র্য ও সাংস্কৃতিক সংঘাতের ভারে ন্যুব্জ।

এই সংকট শুধু শিক্ষার্থীর নয়, বরং আরও গভীরভাবে শিক্ষকের। সমাজের কাছে শিক্ষক যেন সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক—চারপাশে কত খেলাধুলা, কত উত্তেজনা, কত রাজনীতি; কিন্তু ভুল করলেই জাহাজ ডুবে যায়। সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক যেমন যাত্রীদের আনন্দ-উল্লাসে বিভ্রান্ত হতে পারেন না, তেমনি শিক্ষকও সমাজের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা আবেগী টানাপোড়েনে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারেন না। তাঁর প্রধান পরিচয়—তিনি শিক্ষক। শিক্ষক যদি বৈজ্ঞানিক মনন, বিচারবুদ্ধি আর মানবিক দায়িত্ব ভুলে যান, তবে শিক্ষা মানুষ গড়তে পারে না। তখন শিক্ষক হয়ে ওঠেন কেবল সিলেবাসের বাহক, পরীক্ষার প্রস্তুতকারক—মানুষের মনের লালনকারী নন। আর তখন শিক্ষা হয়ে ওঠে কেবল পরীক্ষার প্রস্তুতি আর সনদের উৎপাদন।

ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, শিক্ষার ভিত্তি নিয়ে না ভাবার ফলেই শিক্ষা ও জীবনের মধ্যে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মধ্যে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলা যে আবশ্যক। শিক্ষা হওয়া উচিত চরিত্রগঠন, বুদ্ধির উৎকর্ষ এবং মানবজাতির সঞ্চিত অভিজ্ঞতার দ্বার উন্মোচনের চাবিকাঠি, যা মানবজাতির যুগযুগান্তরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যম সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই লক্ষ্যগুলো ক্রমেই আড়ালে চলে গেছে। এখন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশু বা তারুণ্যের স্বাভাবিক কৌতূহল, নিজে শেখার সুযোগ, বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ—সবই ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কেননা শিক্ষার প্রতিটা স্টেপ যেন একটি কাগজ প্রাপ্তিতে এগিয়ে চলছে,— অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মন এখন যেনো পরীক্ষার দখলে চলে গছে, সবকিছুই পরীক্ষাকেন্দ্রিক ব্যবস্থার চাপে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। ফলে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছে ছাত্রছাত্রীরা আবিষ্কার করে, তারা অনেক কিছু পড়েছে ঠিকই, কিন্তু চিন্তা করতে শেখেনি।

এই সংকটের শিকড় গভীরে প্রোথিত। কালিদাস ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থা দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করেছে। ইংরেজি ভাষার প্রতি অতিমাত্রিক আসক্তি ও অস্বাভাবিক মোহ এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ তৈরি করেছে, যারা পশ্চিমা বই পড়ে, পশ্চিমা ছাঁচে চিন্তা করে, কিন্তু নিজের সমাজের বাস্তব সমস্যাগুলো ভারতীয় বা বাঙালি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে অক্ষম। এই নব্য ইংরেজিতে শিক্ষিত শ্রেণি পশ্চিমের বই পড়ে, পশ্চিমের চোখে দেশকে দেখে, কিন্তু নিজের সমাজকে বোঝে না। ফলে জন্ম নেয় এক কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ—যেখানে সমস্যা কৃত্রিম, সমাধানও কৃত্রিম। এই কৃত্রিম সমাধানের খেসারত দিতে হয় পুরো সমাজকে। দুঃখজনক হলো, ক্ষমতার জোরে সমাজের উপর চাপিয়ে দেওয়া এই কৃত্রিম সমাধানগুলোই সাধারণ মানুষকে করে পণ্য, নিজেকে করে যেনো ধন্য। 

আরো পড়ুন, ভাবুন, প্রশ্ন করুন: 'পথিক, তুমি কি আসলেই পথ হারাইয়াছো?' — শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম ও জিপিএ-৫ এর গোলকধাঁধায় বঙ্কিম ও নজরুল

এই বিচ্ছিন্নতা সবচেয়ে নির্মম রূপে তীব্রভাবে ধরা পড়ে উচ্চশিক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয় যেন হয়ে ওঠে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ—যেখানে পাঠ্যসূচি আছে, শ্রেণিকক্ষ আছে, পরীক্ষার নিয়ম আছে, ডিগ্রি আছে— কিন্তু সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে জীবনের সঙ্গে সংযোগকেই করে ফেলেছে খুবই দুর্বল। এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, প্রকৃত শিক্ষা হলো জাতীয় শিক্ষা—যেখানে ইতিহাস, সমাজ, দারিদ্র্য, মানুষের শারীরিক ও মানসিক বাস্তবতা বিবেচনায় আসে। আর ইতিহাস, সমাজ, দারিদ্র্য, মানুষের শারীরিক ও মানসিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বিণির্মাণ হবে এই ‘জাতীয় শিক্ষা’র —কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে এর প্রতিফলন আমাদের উচ্চশিক্ষায় খুব কমই দেখা যায়। আসলে বাস্তবে আমরা কী দেখছি? আর উপমহাদেশে গুলোতে সেই ১৮৫৭ হতে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সূচনা ঘটে। আর এই একশত আটষট্রি বছরের ইংরেজি শিক্ষার ফলে আমরা “ভাঙতে শিখেছি, গড়তে শিখিনি”; জ্ঞান অর্জন করেছি, কিন্তু আত্মনির্ভরতা অর্জন করিনি। ফলাফল হিসেবে আমরা এমন এক প্রজন্ম তৈরি করছি, যারা ডিগ্রি অর্জন করে, কিন্তু আত্মনির্ভরতা অর্জন করে না। উদ্যোক্তা তৈরি হয়না, মাছি মারা কেরাণীর প্রতিই আগ্রহ বেশি দেখা যায়।

এই সংকট আরও জটিল ও তীব্র হয়েছে দ্বৈত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে। একদিকে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, অন্যদিকে মক্তব-মাদ্রাসা। এই দুই ধারার শিক্ষার্থীদের মনোজগত, দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি ভাষাও আলাদা। আর শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক অবস্থান ভিন্ন হওয়ায় সমাজের ভেতরে তৈরি হয়েছে এক স্থায়ী বিভাজন । মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের সংযোগ ঘটাতে না পারায় এক অদৃশ্য আড়ষ্টতা তৈরি হয়; আবার সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্বল হয়ে পড়ে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা। ফলস্বরূপ মানবিক উচ্চ আদর্শের মানুষ তৈরি না হওয়াতে সমাজে মূল্যবোধের সংকট আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়। । সার্বিকভাবে উভয় ধারাই যেন অসম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিজাতীয় ইংলিশ মিডিয়াম। আরেক অদ্ভূত সামাজিক দ্যোত্যনা তৈরি করছে।

স্বাধীনতার পর কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল—সবার জন্য উন্মুক্ত, গবেষণাভিত্তিক, সমাজ-সংযুক্ত উচ্চশিক্ষা—তার বাস্তবায়িনতো দূরের কথা, অনেকটাই এখনোও কাগজেই রয়ে গেছে। তাইতো সালাহউদ্দীন আহমদ যথার্থই বলেছেন, “আজও আমরা সমরূপ ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি।” কী জানি, কখনো পারবো কীনা? কিন্তু ইত্যোবৎসরে বেকাত্বে তৈরির কারখানা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তার ঘটেছে, সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ, কিন্তু গুণগত মান বাড়েনি। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে, অথচ কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার যোগসূত্র দুর্বলই রয়ে গেছে।

শামসুল হক যেভাবে উচ্চশিক্ষার সমস্যাগুলোর এক দীর্ঘ তালিকা চিহ্নিত করেছেন, তা যেন আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতারই বিবরণ—অপরিকল্পিত বিস্তার, প্রশাসনিক দুর্বলতা, গবেষণার অভাব, দক্ষ শিক্ষকের সংকট, পঠনসামগ্রীর অপ্রতুলতা, দলীয় রাজনীতির ছোবলে শিক্ষার আদর্শহীনতা। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে বাংলাভাষায় মানসম্মত পাঠ্যবইয়ের অভাব। আর মাতৃভাষায় এই মানসম্মত পাঠ্যবইয়ের অভাব উচ্চশিক্ষাকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। আমরা মুখে মুখে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের অঙ্গীকার করি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন বাংলা পাঠ্যবই সরবরাহে কার্যকর উদ্যোগ খুব কমই দেখা যায়।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সময় ও সম্পদের অপচয়ের সিস্টম লস। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের কোর্স শেষ করতে ছয় বছর লেগে যাওয়া কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়—এটি শিক্ষাব্যবস্থার গভীর অসুস্থতার লক্ষণ। এতে যেমন শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের মূল্যবান সময় হারায়, তেমনি পরিবার আর্থিক চাপে পড়ে, এবং সর্বোপরি সমাজ পায় এক হতাশ প্রজন্ম।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, শিক্ষার গুণগত মানের অবনতি এবং বেদনাদায়ক হলো নৈতিকতার অবক্ষয় যেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে এগোচ্ছে। আসলে শিক্ষা যদি মনকে মুক্ত না করে, শক্তিশালী না করে, জীবনের সঙ্গে খাপ না খায়—তবে সে শিক্ষা আসলে শিক্ষাই নয়। আজকের উচ্চশিক্ষা অনেক ডিগ্রি দেয়, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি দেয় না; চাকরির স্বপ্ন দেখায়, কিন্তু জীবনের অর্থ বোঝায় না। মানবের জন্য উদার হতে বলে না।

তবু এই দীর্ঘ সংকটের মধ্যেও আশার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। কেননা এই অন্ধকারের মধ্যেও একটি সত্য রয়ে যায়—শিক্ষাই পারে সকল সংকট থেকে মুক্তির পথ দেখাতে। শিক্ষা সংস্কারের অর্থ দ্রুত পরিবর্তন নয়; বরং গুণগত মানের উপর জোর দেওয়া, পরিমাণের উপর নয়। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় বাস্তবতার সঙ্গে শিক্ষাক্রমকে সংযুক্ত করা, গবেষণা ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, শিক্ষকের মর্যাদা ও দায়িত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠাম করা, এবং সর্বোপরি মানুষের ভেতরের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য উচ্চশিক্ষার পুণর্নির্মাণ করা। মনে রাখা জরুরি যে, শিক্ষা কোনো যান্ত্রিক প্রকল্প নয়—এটি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এক সাংস্কৃতিক সাধনা। শিক্ষা সংকটের আশু সমাধানের কোনো আলাদীনের জাদুর প্রদীপ নেই—এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে চলা শিক্ষা-সংকট তাই কেবল কাঠামোগত সমস্যা বা নীতিগত বিষয়ই নয়—এটি একটি প্রকট মানসিকতার সংকটও বটে। উচ্চশিক্ষার বেহাল দশা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়—শুধু ডিগ্রি দিয়ে জাতি গড়া যায় না; জাতি গড়তে প্রয়োজন দক্ষ, মানবিক, উদ্ভাবনী ও নৈতিক বোধসম্পন্ন মানবসম্পদ।

দেশ গড়তে প্রয়োজন এমন এক প্রজন্ম—যাদের চিন্তা, চরিত্র ও মানবিক বোধ দিয়ে সমাজকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যারা নিত্যনতুন উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগ ঘটাবে এবং দেশ ও দশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করার সক্ষমতা রাখবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের এই ধরণের উচ্চতর মানসিক স্তরে উন্নীত করতে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজন আমূল সংস্কার।

আমাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের মূল চাবিকাঠি কিন্তু উচ্চশিক্ষাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে দক্ষ করে গড়ে তোলা। তাদের লক্ষ্য হতে হবে দেশের প্রয়োজনের সাথে সংগতি রেখে এমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা, যারা হবে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানমনস্ক ও উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। একইসাথে তারা নৈতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক চেতনারও ধারক-বাহক হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে এই বোধটুকু ফিরিয়ে আনাই আজ আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার ওপরই পুরো জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে। একটি সমতাভিত্তিক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ গড়তে হলে উচ্চশিক্ষার এই সংস্কার ও রূপান্তর অপরিহার্য। তাই আলোচনার শেষে বাউলের সুরেই বলে যাই:

“বাপের ধন তোর খেলো সর্পে
জ্ঞানচক্ষু নাই দেখবি কবে।

চক্ষু আঁধার দেলের ধোঁকায়
কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়।”

—তাই সকলের কাছে আকুতি, নিজ মনকে প্রস্তুত করুন, ইতরপনার কোনো সুযোগ নেই। সংস্কার হতে হবে একান্তই দেশীয় প্রেক্ষাপটে। দুগ্ধেতে যেন চোনা মিশতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। আসলে উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই একটি বড় অংশকে উৎপাদনমুখী করতে কারিগরি শিক্ষায় পাঠাতে হবে। এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই ‘শুদ্ধ রাগে’ বা বিশুদ্ধ চিত্তে অটল থাকতে হবে, তবেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত ‘অটলনিধি’।

অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#বাংলাদেশেরশিক্ষা #শিক্ষাসংকট #উচ্চশিক্ষা #EducationCrisis #HigherEducationBangladesh #জাতীয়শিক্ষা #শিক্ষানীতি #দ্বৈতশিক্ষাব্যবস্থা #ColonialEducation #EducationReform #শিক্ষিতবেকারত্ব #বিশ্ববিদ্যালয় #গবেষণাসংকট #বাংলাভাষাওশিক্ষা #মানসম্মতশিক্ষা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: