odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Wednesday, 10th December 2025, ১০th December ২০২৫
ধলেশ্বরী থেকে টংগিবাড়ী, গজারিয়া থেকে হরগঙ্গা কলেজ—মুন্সিগঞ্জের নদী, মাটি ও মানুষের এক বীরত্বের ইতিহাস (Translation: From Dhaleshwari to Tongibari, from Gazaria to Harganga College — a heroic chronicle of Munshiganj’s rivers, soil, and people.)

ধলেশ্বরীর ঢেউয়ে প্রতিরোধের গান: ৭১-এর মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের রণাঙ্গনের বীরত্বগাথা | Nodi o Matir Lorai – The River & Soil War of Munshiganj 1971

Dr Mahbub | প্রকাশিত: ১০ December ২০২৫ ১০:৩০

Dr Mahbub
প্রকাশিত: ১০ December ২০২৫ ১০:৩০

বিশেষ ফিচার

ধলেশ্বরী থেকে টংগিবাড়ী, গজারিয়া থেকে হরগঙ্গা কলেজ—মুন্সিগঞ্জের নদী, মাটি মানুষের এক বীরত্বের ইতিহাস১৯৭১ সালের মুন্সিগঞ্জ ছিল রণকৌশল আর বীরত্বের এক অনন্য ময়দান। ধলেশ্বরীর নৌযুদ্ধ, টংগিবাড়ীর বিজয়, গজারিয়ার গণহত্যা ও নারীদের অংশগ্রহণ—সবই ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়। ধলেশ্বরীর ঢেউ থেকে টংগিবাড়ীর বিজয়, গজারিয়ার রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ—১৯৭১-এর মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের রণাঙ্গন আজও সাহস, ত্যাগ আর বীরত্বের প্রতীক।
Translation: From Dhaleshwari to Tongibari, from Gazaria to Harganga College — a heroic chronicle of Munshiganj’s rivers, soil, and people In 1971, Munshiganj became a battlefield of courage and strategy — from the Dhaleshwari naval battles to Tongibari’s victory and Gazaria’s tragedy.

৭১-এর মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের রণাঙ্গনের বীরত্ব গাথা

১৯৭১ সালের মুন্সিগঞ্জ ছিল রণকৌশল আর বীরত্বের এক অনন্য ময়দান। বিক্রমপুরের এই অঞ্চলটি ঢাকা থেকে কাছে হওয়ায় কৌশলগতভাবেই এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীমাতৃক এই জনপদে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দুর্ধর্ষ প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে উঠেছিল, তাকে এক কথায় বলা যায় ‘নদী ও মাটির লড়াই’।

৭১-এর মুন্সিগঞ্জ রণাঙ্গনের কিছু উল্লেখযোগ্য গল্প নিচে তুলে ধরা হলো:

  1. ধলেশ্বরীর ঢেউয়ে প্রতিরোধের গর্জন: মুন্সিগঞ্জ শহর ও মহকুমা এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পাকিস্তানি বাহিনী নৌপথকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত। মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন, লঞ্চ বা কার্গোর দখল নিতে পারলে শত্রুকে ঘায়েল করা সহজ হবে। ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীতে মুক্তিযোদ্ধারা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে পাকিস্তানি বড় বড় জাহাজের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাতেন। রাতের অন্ধকারে কচুরিপানার মতো ভেসে গিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়ে পাকিস্তানি গানবোট অকেজো করে দেওয়ার রোমাঞ্চকর সব গল্প আজও লোকমুখে ফেরে।
  2. অপারেশন টংগিবাড়ীপ্রথম স্বাধীনতার সূর্য : মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো টংগিবাড়ী উপজেলা মুক্ত হওয়া। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বিশাল সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দেন। সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এই জয়টি ছিল এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৫ নভেম্বর বিবিসি (BBC) তাদের সংবাদে মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী মুক্ত হওয়ার খবরটি ফলাও করে প্রচার করে, যা সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
  3. হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্প এবং বন্দিশালা:  শহরের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান শক্ত ঘাঁটি বা ‘ক্যাম্প’। এই কলেজ প্রাঙ্গণ ছিল তখন এক আতঙ্কের নাম। এখানেই টর্চার সেল বানিয়ে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করা হতো। ১১ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে শহর ঘিরে ফেললে এই ক্যাম্প থেকেই পাকিস্তানি সেনারা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা কলেজের ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে মুক্তির ঘোষণা দেন।
  4. খাসকান্দি গজারিয়ার রক্তঝরা ইতিহাস: রণাঙ্গনের গল্প শুধু বিজয়ের নয়, বিয়োগান্তক স্মৃতিতেও ভরা। ৯ মে গজারিয়া রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনী ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। খাসকান্দি গ্রামসহ ১০টি গ্রামে তারা নির্বিচারে গুলি চালায়। তবে এই হত্যাকাণ্ড থমকে দেয়নি মুক্তিপাগল মানুষদের, বরং শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে স্থানীয় তরুণরা আরও সংগঠিত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।
  5. গেরিলা যুদ্ধ নৌ-কমান্ডোদের বীরত্ব: মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে গেরিলা আক্রমণ ছিল পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান মাথা ব্যথার কারণ। বিশেষ করে শ্রীনগর, লৌহজং এবং সিরাজদিখান এলাকায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গ্রুপে ভাগ হয়ে পাকিস্তানি টহল দলের ওপর ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে আক্রমণ করতেন। নৌ-কমান্ডোরা লিম্পেট মাইন ব্যবহার করে পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে তাদের সাপ্লাই চেইন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন।

 

মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গন উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ

মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গন ছিল ঢাকা বিজয়ের অন্যতম প্রবেশপথ। স্থানীয় সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, তথ্য দিয়ে এবং খাবার দিয়ে যে সহযোগিতা করেছিলেন, তা এই রণাঙ্গনের গল্পকে পূর্ণতা দেয়। ১১ ডিসেম্বর যখন মুন্সিগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়, তখন তা ছিল মূলত এই সাধারণ মানুষ আর অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ ৯ মাসের সম্মিলিত ত্যাগের ফসল। নিচে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা তুলে ধরা হলো:

ক) ধলেশ্বরীর যুদ্ধ – সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করেছিলো

মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে নৌ-যুদ্ধ বা ধলেশ্বরী নদীর যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানিদের জন্য যমদূত। নদীর প্রতিটি বাঁক আর কচুরিপানাকে ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে কুপোকাত করেছিলেন, তা আজও শিহরণ জাগায়। মুন্সিগঞ্জের অন্যতম দুর্ধর্ষ ‘ধলেশ্বরীর নৌ-অপারেশন’ এবং একজন কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাথা নিচে তুলে ধরছি:

. ধলেশ্বরী নদীর সেই অতর্কিত আক্রমণ: মুন্সিগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী বড় বড় লঞ্চ ও স্পিডবোট ব্যবহার করে নদীপথে টহল দিত। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে, পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় অস্ত্রবাহী কার্গো এবং সাথে দুটি গানবোট ধলেশ্বরী দিয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছে।

  • রণকৌশল: মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন সরাসরি যুদ্ধে পেরে ওঠা কঠিন। তাই তারা নদীর তীরে ঘাপটি মেরে থাকেন। যখন জাহাজগুলো নদীর একটি সংকীর্ণ বাঁকে আসে, তখন মুক্তিযোদ্ধারা ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকা নিয়ে হঠাৎ চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেন।
  • পরিণতি: এলএমজি এবং হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে তারা গানবোটের চালকদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি চালাতে শুরু করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নিখুঁত নিশানায় কার্গোর ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। জাহাজটি ডুবিয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত লোকালয়ে মিশে যান। এটি ছিল ‘হিট অ্যান্ড রান’ কৌশলের এক অনবদ্য উদাহরণ।

. কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধাবীর বিক্রম শাহজাহান এবং বীরপ্রতীকদের গল্প: মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনের কথা বললে কমান্ডার শাহজাহান (বীর বিক্রম) বা বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ভোলা অসম্ভব। তাদের অধীনেই গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী।

  • গেরিলা অপারেশন: মুন্সিগঞ্জের লৌহজং এবং সিরাজদিখান অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত ছিলেন। রাতে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের বাড়িতে হানা দিতেন এবং দিনের বেলা সাধারণ কৃষকের ছদ্মবেশে পাকিস্তানি ক্যাম্পের তথ্য সংগ্রহ করতেন।
  • হ্যান্ড গ্রেনেড অপারেশন: মুন্সিগঞ্জের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা এতটাই সাহসী ছিলেন যে, অনেক সময় গামছায় হ্যান্ড গ্রেনেড বেঁধে সাঁতরে গিয়ে পাকিস্তানি গানবোটে মাইন লাগিয়ে আসতেন। এই 'জলযোদ্ধা' বা নৌ-কমান্ডোদের কারণে পাকিস্তানি সেনারা রাতে ধলেশ্বরী বা মেঘনা দিয়ে যাতায়াত করতে ভয় পেত।

. সাধারণ মানুষের অবদান: রণাঙ্গনের গল্পের একটি বড় অংশজুড়ে আছেন স্থানীয় মায়েরা। তারা নিজের জীবন বাজি রেখে মাটির নিচে গর্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। শত্রুসেনারা বাড়িতে তল্লাশি চালাতে এলে তারা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করতেন। মুন্সিগঞ্জের সাধারণ মানুষের এই নিঃস্বার্থ সমর্থনই রণাঙ্গনকে সচল রেখেছিল।

. চূড়ান্ত বিজয়১১ ডিসেম্বরের ভোর: ১০ ডিসেম্বর রাত থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে শহর মুন্সিগঞ্জ ঘিরে ধরেন। হরগঙ্গা কলেজের পাকিস্তানি ক্যাম্প লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে যে, পালানো ছাড়া আর পথ নেই। অবশেষে ধলেশ্বরীর কুয়াশাচ্ছন্ন বুক চিরে ১১ ডিসেম্বর ভোরে তারা মুন্সিগঞ্জ ছেড়ে পালায়।

একটি ঐতিহাসিক তথ্য: মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী মুক্ত হওয়ার সংবাদ বিবিসি যখন প্রচার করে, তখন সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারে যে বাংলাদেশের জেলা শহরগুলোর পতন শুরু হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সন্নিকটে

 

খ) 1971 এর রণাঙ্গনে এক রক্তাক্ত মহাকাব্য: মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া খাসকান্দির যুদ্ধ

মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে গজারিয়া ও খাসকান্দি হলো এক রক্তাক্ত মহাকাব্য। ১৯৭১ সালের ৯ মে গজারিয়ার মাটিতে পাকিস্তানি বাহিনী যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা কেবল মুন্সিগঞ্জ নয়, গোটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম জঘন্যতম গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত।

নিচে গজারিয়া ও খাসকান্দির সেই বিভীষিকাময় রক্তঝরা ইতিহাসের খতিয়ান তুলে ধরা হলো:

. কালরাত্রি মে, ১৯৭১: সেদিন ছিল রবিবার। ঈদের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। ভোরের আলো ঠিকমতো ফোটার আগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বিশাল দল কয়েকশ’ নৌযান ও গানবোট নিয়ে মেঘনা নদী পার হয়ে গজারিয়া আক্রমণ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল গজারিয়া সংলগ্ন গ্রামগুলো।

. অবরুদ্ধ ১০ গ্রাম বধ্যভূমি: হানাদাররা গজারিয়া সদর, খাসকান্দি, ভবেরচরসহ আশপাশের অন্তত ১০টি গ্রাম কর্ডন বা ঘেরাও করে ফেলে। কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই সাধারণ গ্রামবাসী আটকা পড়েন। খাসকান্দি গ্রামটি ছিল এই নৃশংসতার কেন্দ্রবিন্দু। পাকিস্তানি সেনারা প্রতিটি বাড়িতে ঢুকে পুরুষদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনে।

  • নিরীহদের সারি: মেঘনা নদীর তীরের ধানক্ষেতে বা গ্রামের ফাঁকা জায়গায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয় সাধারণ মানুষকে।
  • নির্বিচারে গুলি: কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই স্টেনগান আর ব্রাশফায়ারে কয়েক মিনিটে লুটিয়ে পড়ে কয়েকশ’ তাজা প্রাণ।
  • ৩৬০ জন শহীদ: সরকারি হিসাব মতে, সেদিন গজারিয়া ও খাসকান্দি এলাকায় ৩৬০ জন নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রক্তে লাল হয়ে যায় মেঘনার পানি আর খাসকান্দির মাটি।

. খাসকান্দিরমরণকূপ অগ্নিসংযোগ: গুলি করার পর ঘাতকরা ক্ষান্ত হয়নি। তারা অনেক আহত মানুষকে জীবিত অবস্থায় গণকবরে মাটিচাপা দেয়। এরপর কয়েকশ’ ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে উৎসবের অপেক্ষায় থাকা গ্রামগুলো পরিণত হয় শ্মশানে। স্বজনহারা মানুষের আহাজারি আর আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

. শোক থেকে শক্তির উত্থান: গজারিয়ার এই গণহত্যা স্থানীয় মানুষের মনে দাউ দাউ করে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। যে তরুণেরা দ্বিধায় ছিলেন, খাসকান্দির সেই রক্ত তাদের রণাঙ্গনে টেনে নিয়ে আসে।

  • মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ: এই হত্যাকাণ্ডের পরই গজারিয়ায় স্থানীয় মুক্তিবাহিনী সুসংগঠিত হয়। শহীদ পরিবারের সন্তানরা শপথ নেন দেশ মুক্ত না করে ঘরে ফিরবেন না।
  • প্রতিরোধ: পরবর্তীতে গজারিয়া অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন, যা পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে।

. বর্তমান স্মৃতি শ্রদ্ধা

আজও খাসকান্দির সেই বধ্যভূমি আর মেঘনার পাড় সেই কালরাত্রির সাক্ষ্য বহন করে। স্থানীয়ভাবে নির্মিত স্মৃতিসৌধটি শহীদদের নাম আগলে রেখেছে। প্রতি বছর মুন্সিগঞ্জ মুক্ত দিবস বা মে মাসে এলাকাবাসী অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই শহীদের স্মরণ করেন।

সংক্ষিপ্ত টীকা: খাসকান্দি গণহত্যা ছিল বাঙালিদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার একটি চাল, কিন্তু এটি মুন্সিগঞ্জের মানুষকে উল্টো আরও বেশি বিদ্রোহী করে তুলেছিল, যার চূড়ান্ত ফলাফল আমরা দেখি ১১ ডিসেম্বরের বিজয়ে

 

মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে গেরিলা যুদ্ধ এবং নৌ-কমান্ডোদের ভূমিকা

মুন্সিগঞ্জের রণাঙ্গনে গেরিলা যুদ্ধ এবং নৌ-কমান্ডোদের ভূমিকা ছিল এক অনন্য রণকৌশলের পরিচয়। নদীমাতৃক এই জনপদটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ সরবরাহের অন্যতম প্রধান রুট। এই রুটটি অচল করে দিতে মুক্তিযোদ্ধারা যে অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, তা ছিল বিশ্বমানের গেরিলা যুদ্ধের উদাহরণ। নিচে মুন্সিগঞ্জের গেরিলা ও নৌ-কমান্ডোদের বীরত্বের আখ্যান তুলে ধরা হলো:

১. হিট অ্যান্ড রান দুর্ধর্ষ গেরিলা যুদ্ধ: মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, লৌহজং এবং সিরাজদিখান অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী গেরিলা নেটওয়ার্ক।

  • কৃষক ছদ্মবেশ: মুক্তিযোদ্ধারা দিনের বেলা লুঙ্গি পরে, কাস্তে হাতে সাধারণ কৃষকের ছদ্মবেশে পাকিস্তানি ক্যাম্পের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং সব তথ্য সংগ্রহ করতেন। সন্ধ্যা নামলেই তারা দুর্ধর্ষ যোদ্ধায় পরিণত হতেন।
  • টেলিফোন সড়ক কালবার্ট বিচ্ছিন্নকরণ: স্থানীয় গেরিলারা পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তারা রাতের অন্ধকারে পোল্ট্রি গ্র্যান্ড এবং ডিনামাইট দিয়ে বড় বড় কালভার্ট ও টেলিফোন লাইন উড়িয়ে দিতেন, ফলে পাকিস্তানিরা এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হতো।

. নৌ-কমান্ডোদেরঅপারেশন জ্যাকপটস্টাইল: মুন্সিগঞ্জের উত্তাল মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীতে নৌ-কমান্ডোরা ছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের সাক্ষাৎ যম। তাদের লড়াইয়ের ধরণ ছিল অবিশ্বাস্য:

  • লিম্পেট মাইনের ব্যবহার: প্রশিক্ষিত নৌ-কমান্ডোরা রাতের আঁধারে কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে পাকিস্তানি জাহাজ বা গানবোটের নিচে চলে যেতেন। এরপর পানির নিচে ডুব দিয়ে তারা জাহাজের গায়ে 'লিম্পেট মাইন' লাগিয়ে দিতেন। কিছুক্ষণ পরই বিকট শব্দে শত্রু জাহাজ মাঝ নদীতেই ডুবে যেত।
  • জলপথে সাপ্লাই চেইন ধ্বংস: ঢাকা থেকে চাঁদপুর বা বরিশালগামী পাকিস্তানি রসদবাহী ট্রলারগুলোকে মুক্তিযোদ্ধারা ধলেশ্বরীর সংকীর্ণ চ্যানেলগুলোতে আক্রমণ করে জব্দ করতেন। এই কমান্ডোদের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী মুন্সিগঞ্জের নদীপথে চলাচল করতে প্রচণ্ড আতঙ্কিত থাকত।

. কমান্ডো সিরাজউদ্দৌলা তাঁর বীরত্ব: মুন্সিগঞ্জের নৌ-কমান্ডোদের কথা বলতে গেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজউদ্দৌলার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তিনি এবং তাঁর দল বেশ কিছু সফল অপারেশন পরিচালনা করেন।

  • ধলেশ্বরীর লড়াই: একবার ধলেশ্বরী নদীতে পাকিস্তানি গানবোটের ওপর আক্রমণ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সাঁতরে গানবোটের ইঞ্জিন বিকল করে দেন। এই অসীম সাহসিকতা মুন্সিগঞ্জের নৌ-যুদ্ধকে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে দিয়েছে।

. নারীদের ভূমিকা রণক্ষেত্রে ছায়া সহযোদ্ধা: গেরিলা যুদ্ধের সফলতার পেছনে স্থানীয় নারীরা ছিলেন এক বড় শক্তি। তারা কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার বা আশ্রয় দিতেন না, বরং নিজেদের আঁচলের নিচে গ্রেনেড লুকিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পৌঁছে দিতেন। অনেক সময় নারী গেরিলারা পাকিস্তানি ক্যাম্পে তথ্য পাচারের গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছেন।

. প্রভাব ১১ ডিসেম্বরের বিজয় ত্বরান্বিতকরণ: গেরিলা ও নৌ-কমান্ডোদের এই ক্রমাগত আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। তারা শহরের ক্যাম্পে (যেমন হরগঙ্গা কলেজ) অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। যখন জল ও স্থল উভয় পথ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদাররা ১১ ডিসেম্বর ভোরে পালানোর পথ খোঁজে।

সংক্ষিপ্ত টীকা: মুন্সিগঞ্জের গেরিলা যুদ্ধ প্রমাণ করেছিল যে, অস্ত্রশস্ত্র কম থাকলেও মেধা আর মাটির প্রতি মমতা থাকলে আধুনিক সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করা সম্ভব

অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#Munshiganj1971 #BikrampurWar #DhaleshwariBattle #GazariaMassacre #BangladeshLiberationWar #FreedomFighters #RiverAndSoilWar #JoyBangla #VictoryDayBangladesh #Muktijuddho



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: