ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নার্গিস, মাসা ও ইরানের মানবাধিকার

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৫৭

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৫৭

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের প্রথম সারির একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আয়রন সাইড স্টেট স্কুল। এই স্কুলে আমার সন্তানের সহপাঠী একজন ইরানি শিশু। ফুটফুটে, মায়াবী চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত, সপ্রতিভ এই শিশুটি সহজেই সবার নজর কাড়ে। স্কুল শুরুর সময় ও শেষে এই শিশুটির পরিবারের সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠেছিল। শিশুটির বাবা-মা দুজনই শিক্ষকতা করতের তেহরানের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু কট্টর ইসলামী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে সন্তানকে নতুন জীবন দিতে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে এই দম্পতির সাথে মাঝে মধ্যেই আলাপ হতো।

ইরানের সভ্যতা হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ। আমাদের সবারই জানা পূর্বে পারস্য নামে পরিচিত এই  ভূখণ্ডে এক সময় উন্নত সংস্কৃতির চর্চা হতো হয়তো এখনও হয়। আমি মনে করি শাসক যতই কঠোর হোক না কেনো সংস্কৃতি চর্চার ধারাকে রোধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। ইরানের মহাকবি ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ মহাকাব্য বিশ্ব সাহিত্যের অপরিহার্য অংশ। এছাড়া বর্তমান যুগে ইরানের চলচ্চিত্রও বিশ্ব দরবারে মাঝে মধ্যেই আলোচনা তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইরানি বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার মাজিদ মাজিদীর ‘চিলড্রেন অব হ্যাভেন (১৯৯৭)’, ‘কালার অব প্যারাডাই (১৯৯৯)’ ও সাম্প্রতিক সময়ে ‘মোহাম্মদ: দ্যা ম্যাসেঞ্জার অব দ্য গড (২০১৫)’ দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। এ বছরের এপ্রিল মাসে আমার সন্তানের সহপাঠীর মায়ের সাথে স্কুল চত্ত্বরে কথা হচ্ছিলো সাম্প্রতিক ইরান নিয়ে। তিনি জানিয়েছেন, ইরান বিশ্ব সভ্যতার থেকে খুব পিছিয়ে নয়। ইরানের রাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার কাঠামোও বেশ শক্তিশালী। একইসাথে ইরান প্রযুক্তিগতভাবেও বেশ এগিয়ে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এরপর তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মাসা আমিনীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘিরে দেশটির সাম্প্রতিক আন্দোলন, জাগরণ ও হত্যাকা- সম্পর্কে। এ বিষয়ে তিনি আমার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেননি। কিন্তু মাসা আমিনীর মৃত্যু ও এরপরের আন্দোলনে বর্বর হত্যাকান্ডে তিনি যে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ সেটা লুকাতে পারেননি। উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, মাসা আমিনী হত্যাকান্ডের প্রতিবাদের সারাদেশের গণআন্দোলন দমাতে পাঁচ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী।

ছড়ানোর অভিযোগে যিনি এখনও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে বন্দি। এখনও পর্যন্ত তিনি, ১৩ বার গ্রেফতার হয়েছেন। বিচারে ৫ বার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। কারাদ- হয়েছে ৩১ বছরের। এছাড়া তাঁকে ১৫৪টি বেত্রাঘাতের দ-ও দেওয়া হয়েছে। ৫১ বছর বয়সী জীবনে ৩১ বছরের কারাদন্ডের সাজা নিয়েও নার্গিস মোহাম্মদি ইরানের নারীদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অধিকারের কথা বলে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি ইরানের মানবাধিকার সংস্থা ডিফেন্ডারস অব হিউম্যান রাইটস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিরেন ইরানের আরেক বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার কর্মী নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শিরীন এবাদি।

এক সময়ের উদার, সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল, সংস্কৃতিবান ইরানের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি কি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটা উত্তরই পাওয়া যায়। কট্টর ইরানে মাসা আমিনীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাজপথে নামা মানুষের সাথে এখনও বর্বর আচরণ করছে ইরানের রাষ্ট্রীয় বাহিনী। হাজার হাজার মানুষকে জেলে ভরা হয়েছে। কারাগারে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন হাজার হাজার প্রতিবাদী। যাদের অনেকেই নারী। যদিও তাদের এখনও দমন করা যায়নি। আর সেকারণেই বিশ্বের নানাপ্রান্তে নার্গিস মোহাম্মদির মতো অধিকার কর্মীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে হাজার হাজার, লাখ-লাখ মুক্তিকামী, সংবেদনশীল মানুষ উচ্চারণ করছেন সেই মন্ত্র- ‘নারী-জীবন-স্বাধীনতা’ ('Woman, life, liberty')। 

লেখক: রাহাত মিনহাজ, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: