odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২ ভাদ্র ১৪৩২

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.): সাম্য, ন্যায় ও মানবতার পথে আমাদের প্রতিজ্ঞা

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:৫৪

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:৫৪

বিশেষ সম্পাদকীয়

আজ ১২ রবিউল আউয়াল। ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি উজ্জ্বল এক রেখাচিত্র—যেখানে একদিকে নবজাতকের আগমনে পৃথিবী পায় আলোর স্ফুলিঙ্গ, আর অন্যদিকে বিদায় জানানো মহানবীর শূন্যতায় ভরে ওঠে বিশ্বচিন্তা। এই একক দিনে জন্ম ও মৃত্যুর দুই চূড়ান্ত বাস্তবতা একসাথে জড়ো হয়ে মানবসভ্যতাকে শোনায় একটি চিরন্তন আহ্বান—আত্মশুদ্ধি, ন্যায় ও সহমর্মিতার পথে ফিরে আসার ডাক।

প্রায় দেড় হাজার বছর আগে, যখন আরব সমাজ ডুবে ছিল জাহেলিয়াতের আঁধারে, তখন তিনি এসেছিলেন তাওহিদের আলো, ন্যায়ের বার্তা ও শান্তির প্রতীক হয়ে। কুসংস্কার, নারী অবমাননা, দাসত্ব আর বৈষম্যের এক ভয়াবহ সমাজব্যবস্থাকে তিনি বদলে দিয়েছিলেন মানবিকতার এক উদ্ভাসিত আদর্শে।

মহানবী (সা.)-এর সংগ্রামের শুরু সেই শিশুকাল থেকেই। তিনি জন্মের আগেই বাবাকে হারান, ছয় বছর বয়সে হারান মাকেও। শৈশবের সেই শূন্যতা তাঁকে গড়ে তোলে মানব-মন বুঝে নেওয়ার এক অতুলনীয় ক্ষমতায়। তাঁর কষ্টের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় দয়ার গভীরতা, সহানুভূতির প্রশস্ততা, আর মানুষের প্রতি ভালোবাসার এমন এক রূপ, যা আজও অনুপ্রাণিত করে শত কোটি হৃদয়কে।

তিনি ছিলেন গৃহহীন, অথচ অসংখ্য মানুষের আশ্রয়। তিনি ছিলেন নিঃস্ব, অথচ ছিলেন দানশীলতার প্রতীক। তিনি ছিলেন নিরস্ত্র, অথচ ছিলেন শক্তিশালী ন্যায়ের ধারক। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নৈতিক শক্তিই পরিণত হয় মানবতার শ্রেষ্ঠ অনুসরণীয় আদর্শে।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভাষণ ছিল মাহানবীর বিদায় হজের ভাষণ, যা আজীবন বিবেচিত হবে চিরন্তন মানবতা সংহিতা হিসেবে। "কোনো আরব অনারবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, শ্রেষ্ঠতা কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে"—এই ঘোষণা শুধু ধর্মীয় নয়, এটি সভ্যতা গড়ার নৈতিক ভিত্তি। বিদায় হজে তিনি বলেছিলেন, "নারী-পুরুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। শ্রমিকের শ্রমের প্রকৃত মূল্য দিতে হবে। এতিমের অধিকার হরণ করা যাবে না।"

এই ঘোষণা আজও প্রাসঙ্গিক—যেখানে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে, রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ন্যায়পরায়ণতা, অর্থনীতিতে নৈতিকতার সংকট, এবং সহমর্মিতা হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্কের ভেতর থেকে।

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলমানরা আজ দরুদ পাঠ, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া মাহফিল, বইমেলা ও আলোচনা সভার মাধ্যমে স্মরণ করছেন এই মহামানবকে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ নানা পর্যায়ের নেতারা বাণীতে আহ্বান জানাচ্ছেন—নবীর আদর্শ জীবনে ধারণের।

কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—এই আয়োজন কি শুধু আনুষ্ঠানিকতা, নাকি আমরা সত্যিই তাঁর শিক্ষা বাস্তবে রূপ দিচ্ছি? প্রিয়নবী (সা.)-কে ভালোবাসা মানে কেবল মিলাদে অংশ নেওয়া নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, দয়ার হাত বাড়ানো এবং ন্যায়ের পক্ষে নির্ভীক থাকা।

আজকে এই অস্থির পৃথিবীতে মিলাদুৃন্নবীর আয়োজন নয়, হৃদয়ে ধারণই হোক মূল লক্ষ্য। আজ বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার মুসলমানরা দরুদ, কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, সেমিনার, বইমেলা আর নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালন করছেন ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। রাষ্ট্রীয় বাণীতে নেতারা আহ্বান জানাচ্ছেন নবীর শিক্ষা ধারণের।

তবে বাস্তব প্রশ্ন হলো—আমরা কি শুধু স্মরণ করছি, না অনুসরণ করছি? প্রিয়নবী (সা.)-এর ভালোবাসা কি শুধু শব্দের সীমায়, না কি কর্মের মধ্যেও?

দরুদ পাঠ নিশ্চয়ই পুণ্যময়, তবে সেই দরুদের প্রতিধ্বনি যদি ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন পৌঁছায় না, নিপীড়িতের জন্য ন্যায় রক্ষা না করে, তবে তা হয়ত হৃদয়ে পৌঁছাতে পারে না। মিলাদ মাহফিলের উপস্থিতি যদি আমাদের বিবেক জাগিয়ে তোলে না, তবে সে স্মরণ হয়ত আচার মাত্র।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) প্রকৃত অর্থেই হচ্ছে মানবতার আলোয় নবজাগরণের স্মরণদিবসতিনি মানুষকে শিখিয়েছেন—সবাই সমান, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, শ্বেত-শ্যম বা আরব-আনআরবের ভেদাভেদ নেই। বিদায় হজের ভাষণে তাঁর কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়েছিল চিরন্তন সত্য: ন্যায়বিচার কারও বিশেষ সুবিধা নয়, এটি সমগ্র মানবতার অধিকার। নারীকে তিনি মর্যাদা দিয়েছেন, শ্রমিককে সম্মান করেছেন, এতিমকে আশ্রয় দিয়েছেন। তাঁর জীবন ছিল দুঃখী, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে নির্ভীক সংগ্রাম।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শান্তি, ন্যায় আর ভালোবাসা ছাড়া সমাজ টিকে না। আজকের বিভেদ আর সহিংসতার পৃথিবীতে তাঁর শিক্ষা হলো সবচেয়ে বড় দিশারী। যদি আমরা সত্যিই তাঁকে ভালোবাসি, তবে আমাদের রাজনীতিতে আনতে হবে ন্যায়পরায়ণতা, সমাজে গড়তে হবে সহমর্মিতা, অর্থনীতিতে স্থাপন করতে হবে নৈতিকতা, আর রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমতা।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের জন্য তাই কেবল একটি স্মরণোৎসব নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও পরিবর্তনের অঙ্গীকারের দিন। নবীর শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব কেবল ন্যায়, দয়া ও সহমর্মিতার চর্চার মাধ্যমে। আজকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্ব যদি এই শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করতে পারে, তবে প্রকৃত অর্থেই এই দিনটি হবে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের অঙ্গীকারময় দিবস।

আজকের দুনিয়ায় নবীর শিক্ষা বড় প্রয়োজন। বিশ্ব আজ বিভক্তি, বৈষম্য ও সংঘাতের দুঃসময় পার করছে। ধর্মের নামে হানাহানি, অর্থনীতির নামে শোষণ, রাজনীতির নামে নিষ্ঠুরতা চলছে নির্দ্বিধায়। এই অন্ধকার সময়েই আবারও দরকার সেই আলোর দিশা—যা একসময় এসেছিল হেরা গুহা থেকে, যা বিস্তার লাভ করেছিল মানুষের হৃদয়ে, কেবল যুদ্ধ বা জয় দিয়ে নয়, বরং উদারতা, করুণা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

পরিশেষে বলা যায়, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কেবল অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের নির্মাণের আহ্বান। তাঁর শিক্ষা কেবল ধর্মীয় গণ্ডিতে নয়, বরং জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার চিরন্তন দিশারী। তাঁকে ভালোবাসা মানে কেবল দরুদ পাঠ নয়, বরং সাহসিকতার সঙ্গে অন্যায়ের প্রতিবাদ; কেবল মিলাদ মাহফিলে অংশ নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনে একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠা। তাঁর আদর্শে গড়ে উঠুক এমন এক পৃথিবী, যেখানে আর কেউ অনাহারে থাকবে না, কেউ অবিচারে কাঁদবে না, কেউ তার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবে না। তবেই ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠবে মানবতার নবজাগরণের মহোৎসব।

প্রিয়নবী (সা.) ছিলেন এক জীবন্ত কোরআন। তাঁর জীবন ছিল মানবতার এক অনন্ত অনুশীলন। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—ইবাদতের চূড়ান্ত রূপ কেবল সিজদায় নয়, বরং নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহসে, ভালোবাসার নিঃশব্দ বিস্তারে। আল্লাহর দিকে মুখ তুলে প্রার্থনা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন সেই দোয়ার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় মানুষের প্রতি আমাদের আচরণে।

তাই আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক—

  • রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনব ন্যায়পরায়ণতা ও জবাবদিহি।
  • সমাজে গড়ে তুলব সহমর্মিতা ও পরস্পরের প্রতি সম্মান।
  • অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠা করব নৈতিকতা ও ন্যায্যতা।
  • পরিবারে ফিরিয়ে আনব ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সংহতি।
  • রাষ্ট্রব্যবস্থায় রোপণ করব সাম্য ও মানবিক নীতির ভিত্তি।

তবেই ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) হবে কেবল স্মরণের দিন নয়, বরং এক জীবন্ত প্রতিজ্ঞার দিন—আলোকিত হৃদয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলব একটি সুবিচারভিত্তিক মানবিক সমাজ।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.): শান্তি ও মানবতার কবিতা পড়ুন https://odhikarpatra.com/news/31813

 

— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: