- সম্পাদকীয়
চাকরি প্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েটদের ন্যায্যতার সংগ্রাম: রাষ্ট্রীয় নিরবতায় মানবতা আজ আইসিউতে- ১৯তম দিনে লাগাতার আন্দোলন/ প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েটদের পদযাত্রা ও অনশন কর্মসূচি / রাজু থেকে শাহবাগে আসলে পুলিশি বাধা- ব্যারিকেড/ মেধাবী প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েটরা শাহবাগের রাস্তায় শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে / একজন দায়িত্বশীল উপদেষ্টার প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েটদের সক্ষমতা ও যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশে ক্ষোভ প্রকাশ/ আইন ও কোর্টের রায়ে দেওয়া অধিকার আদায়ে ৫ দফা দাবী পূরণ না হলে মেধাবী এই প্রতিবন্ধী গ্রাজুয়েটগণ অনশন চালিয়ে যাবেন
ঢাকার বুকে, যেখানে তারুণ্যের রক্তে ভেজা মাটি ইতিহাসের সাক্ষী, সেই শাহবাগে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। পাথরের বুকে খোদিত সেই উদাত্ত আহ্বান—“বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ ,শোন মহাজন, আমরা অনেকজন।…”—একসময় বহু স্বপ্নবাজ তরুণের হৃদয়ে আশা জাগিয়েছিল। তারা রক্ত ঢেলেছিল এই বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
অথচ, আজ সেই পবিত্র স্মারকস্তম্ভের ছায়াতেই, নিদারুণ এক বৈপরীত্যের করুণ কাহিনি রচিত হচ্ছে। সেখানে, টানা উনিশ দিন ধরে একদল অধিকারহারা, অথচ মেধা-দীপ্ত তরুণ-তরুণী খোলা আকাশের নিচে দিন গুনছেন। তাঁরা ‘প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ’-এর সদস্য। উচ্চশিক্ষা নামক দুর্লঙ্ঘ্য পথ পাড়ি দেওয়ার পরও তাঁদের হাতে জোটেনি কর্মসংস্থানের চাবিকাঠি। তাঁদের ন্যায্য অধিকারের আকুতি ৫ নভেম্বর যখন আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলল, তখনো রাষ্ট্রের কর্ণকুহরে তা পৌঁছাল না—যেন এক অদৃশ্য বধিরতা গ্রাস করেছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। ফলস্বরূপ, চরম হতাশার খাদে নেমে গিয়ে তাঁরা এখন যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা এবং আমরণ অনশন কর্মসূচির মতো কঠোর পথে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এই দৃশ্য আমাদের রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তি ও সমতার অঙ্গীকারকে কাঠগড়ায় দাঁড়
কালের স্রোতে মহাজন বদলায়, বৈষম্য দাঁড়িয়েই থাকে
স্মৃতিস্তম্ভের পাথরে খোদিত বৈষম্যমুক্তির সেই শ্লোগান কি তবে নিছকই একটি ধাতব স্ক্রিপ্ট, যার কোনো আত্মা নেই? ইতিহাসের পালাবদলে মহাজন হয়তো পরিবর্তিত হয়েছেন—শাসনের রং বদলেছে, কিন্তু প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের ভাগ্যে বৈষম্যের শৃঙ্খল পূর্বের মতোই অনড়।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে মেধার স্বাক্ষর বহন করে আসা এই অবহেলিত সন্তানেরা খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন, আর তাঁদের কান্না পৌঁছাচ্ছে না মহাজনদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর আড়ালে থাকা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আলিশান ভবনে। যদি পরিবর্তনই আসত, তবে কেন আজও আইনি বাধ্যবাধকতা ও এসডিজি’র বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও, তাঁদের অধিকারের কান্না সেই প্রতিশ্রুতির সুউচ্চ দালানের কাছে পৌঁছাতে পারছে না? কোথায় তবে সেই মুক্তি?
আরো পড়ুন:
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ: বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা রাজপথে—রাষ্ট্র কি শুনতে পাচ্ছে?
দায়মুক্তির দায়সারা গবেষণা
গত ২১ অক্টোবরের সেই সাক্ষাৎকারের কাহিনি আরও বেশি হতাশাজনক। সরকারের দায়িত্বশীল এক উপদেষ্টার সামনে যখন প্রতিনিধি দলটি তাদের বঞ্চনার গাথা তুলে ধরলেন, তখন তাদের সান্ত্বনার বদলে শুনতে হলো দায়সারা মনগড়া অবহেলার উত্তর। অধিকারপত্রের হাতে আসা এক অডিওতে সেই শীতল কণ্ঠস্বর শোনা যায়: “৪ মাসে কি করব?”
প্রশ্ন জাগে—চার মাসে যদি কিছুই করা না যায়, তবে বিগত পনেরোটি মাস কি ঘুমিয়ে কেটেছে? প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্রের পদক্ষেপের খতিয়ান কোথায়? আরও দুঃখজনক হলো, যখন একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই মেধাবীদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন: “তোমাদের নিয়ে আমার গবেষণা করতে হবে।” যে ন্যায্য পাঁচ দফা দাবি নিয়ে তাঁরা লড়ছেন, তার সমাধান তো বহু আগেই বিশ্বের প্রগতিশীল রাষ্ট্রগুলো খুঁজে বের করেছে। তবে, কোন রহস্যের সন্ধানে এই ‘গবেষণা’র অজুহাত? তাঁদের ন্যায্যতার প্রশ্নে যখন সিদ্ধান্তহীনতার এই পর্দা ঝুলে থাকে, তখন প্রশ্ন ওঠে: ১৯৪৭ সাল থেকে বেজে আসা বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শ্লোগান আর কতকাল কেবলই শূন্যে মিলিয়ে যেতে থাকবে?
আর কত অশ্রু, আর কত আত্মত্যাগ?
প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের এই নীরব কান্না কেবল চাকরির জন্য নয়; এটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার মৌলিক অধিকারের জন্য এক মহৎ সংগ্রাম। তাঁদের মেধা দেশের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদকে অবহেলা করা মানে, নিজের ভবিষ্যৎকে অস্বীকার করা।
মহাজন কবে এই নীরব কান্না শুনতে পাবেন? অধিকার পেতে আর কত অশ্রু ঝরাতে হবে, আর কত আত্মত্যাগ স্বীকার করতে হবে এই মেধাবী জনগোষ্ঠীকে? আমরণ অনশনের মতো চরম সিদ্ধান্তের আগেই সরকারের উচিত হবে—জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের পাথরে খোদাই করা অঙ্গীকারকে হৃদয়ে ধারণ করে, দ্রুত, সংবেদনশীল এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। এই মেধাবী সন্তানদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে তাদের কর্মসংস্থানের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা হোক—এটাই হোক রাষ্ট্রের জরুরি অগ্রাধিকারের আখ্যান
সমাধান: শুধু কোটা নয়, সামগ্রিক সংস্কার
শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের প্রতিফলন।
প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের ন্যায্যতার সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য শুধু কোটা প্রবর্তনই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন কয়েকটি সামগ্রিক সংস্কার:
১. স্থায়ী ও কার্যকর কোটা: আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে এবং কার্যকরভাবে প্রতিবন্ধী কোটা সংরক্ষণ ও তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
২. শ্রুতিলেখক নীতিমালার সরলীকরণ: পরীক্ষা পদ্ধতির জটিলতা দূর করতে শ্রুতিলেখক নিয়োগের নীতিমালাকে প্রতিবন্ধী-বান্ধব ও সহজ করা।
৩. 'রিজনেবল অ্যাকোমোডেশন' (Reasonable Accommodation) বাধ্যতামূলককরণ: সকল কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্তিসঙ্গত সহায়ক ব্যবস্থা (যেমন: র্যাম্প, উপযোগী টয়লেট, কম্পিউটার সফটওয়্যার, পরিবর্তিত সময়সূচি) সরবরাহ করা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি: দীর্ঘদিনের বৈষম্যের ফলে সৃষ্ট কর্মজীবনের বিলম্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা অন্তত ৩৫ বছর করা একটি যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ।
৫. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: নিয়োগকর্তা এবং সমাজের মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা
শেষ কথা: বিনিয়োগ, দায় নয়
প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি দেওয়াকে সরকারের জন্য বাড়তি বোঝা বা দায় হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হলো দেশের মানবসম্পদ ও অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ (Investment)। এই শিক্ষিত নাগরিকরা যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখন তারা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের দারিদ্র্য দূর করেন না, বরং দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেন এবং কর প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেন।
অন্ধকার ভেদ করে আলোয় আসা এই গ্র্যাজুয়েটদের সংগ্রাম তাই ন্যায়সঙ্গত। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিয়ে একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতি গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়া।
✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: