—উপসম্পাদকীয়
আইন, কোটা, প্রবেশগম্যতা আর টোকেনিজমের ফাঁদ পেরিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অবিশ্বাস, বঞ্চনা আর অধিকারভিত্তিক দাবির গল্প, যা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে বাংলাদেশের বাস্তবতা। আইন আছে, বিশ্বাস নেই এ যেনো ‘ঘর পোড়া ভয়, আর নতুন প্রত্যাশার লড়াই। আর আজ প্রতিধ্বনিত করুণা নয়, অধিকার—আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষের বঞ্চনা, অবিশ্বাস ও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এই উপসম্পাদকীয়টি অবতারণা করেছে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে অধিকার নিশ্চিত হওয়ার রহস্য উদঘাটনে একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ।
একটি আনুষ্ঠানিক দিন, অসংখ্য অদৃশ্য ক্ষত
৩ ডিসেম্বর বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয় প্রতিশ্রুতির ভাষায়। পোস্টারে ঝলমল করে অন্তর্ভুক্তির কথা, সেমিনারে উচ্চারিত হয় সমতার অঙ্গীকার। কিন্তু এই দিনের কোলাহল থেকে দূরে, বাংলাদেশের পথে–ঘাটে হাঁটা, চাকরির ইন্টারভিউতে বারবার ফেরত আসা, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়ির নিচে থেমে যাওয়া লক্ষ লক্ষ প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে দিবসটি এক অদ্ভুত দ্বৈততা নিয়ে আসে।
রাষ্ট্রের ভাষণে প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু বাস্তবে আছে অবিশ্বাস, ক্ষত আর অমীমাংসিত দীর্ঘশ্বাস। এই বঞ্চনাকে বোঝার জন্য ইতিহাসে ফিরে তাকানো জরুরি। কারণ আজকের সন্দেহ কেবল বর্তমানের নয়, এটি বহু বছরের ব্যবস্থাগত অভিজ্ঞতার ফল।
পদ্ধতিগত বাধা: যেখানে অধিকার তত্ত্বে থাকে, জীবনে নয়
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী অধিকারের জন্য আইন আছে, নীতি আছে, আন্তর্জাতিক চুক্তিও রয়েছে। সবই কাগজে শক্তিশালী। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে সেই শক্তি ভেঙে পড়ার শব্দ প্রতিবন্ধী মানুষেরাই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে শোনেন।
- সমস্যা তাদের শরীরে নয়, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে: সমাজের গভীরে আজও লেগে আছে সেই পুরনো ধারণা, যা প্রতিবন্ধিতাকে ব্যক্তিগত ত্রুটি মনে করে। যেন দায় শরীরের, মানসিকতার, কিংবা জন্মগত কোনো ব্যর্থতার। এর ফলে প্রথম যে আঘাতটি আসে, তা আসে ঘরের ভেতর থেকেই। অনেক পরিবার সন্তানকে আড়ালে রাখে, স্কুলে পাঠায় না, ভুল চিকিৎসায় ঠেলে দেয়। এই নীরব বর্জন একটি শিশুর পৃথিবীকে ক্রমশ ছোট করে দেয়।
- প্রবেশগম্যতা —সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন: বাংলাদেশে হাঁটাহাঁটি, সিঁড়ি পেরোনো, অফিসে ঢোকা, বাসে ওঠা, ব্যাংকে যাওয়া—প্রতিটি সাধারণ কাজই একজন প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে কঠিন পরীক্ষার মতো। হুইলচেয়ারের জন্য র্যাম্প নেই, দৃষ্টিহীন মানুষের জন্য ব্রেইল সাইনেজ নেই, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ সহায়তা নেই, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহারযোগ্য নয়। আইন আছে, কিন্তু তার উপস্থিতি রাস্তায় নেই।
- শিক্ষা ও কর্মসংস্থান— প্রতিশ্রুতির দেয়ালে ধাক্কা: উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পরও একজন প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটের কাছে কর্মসংস্থান অনেক সময় দূরের আলো। সরকারি কোটার ১ শতাংশ আসলে কখনো পূরণই হয় না। বেসরকারি খাতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অজুহাত থাকে শারীরিক সীমাবদ্ধতার নাম করে। এতে তাদের ক্ষতি শুধু আর্থিক নয়, মর্যাদার স্থানেও আঘাত লাগে।
এই সব অভিজ্ঞতা মিলেই তৈরি হয় সেই নীরব ব্যথা, যা কোনো প্রতিবেদন কিংবা পরিসংখ্যান পুরোপুরি ধরতে পারে না।
প্রত্যাশার নতুন ভাষা: করুণা নয়, মর্যাদা
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে প্রতিবন্ধী মানুষদের দাবি আর আগের মতো নয়। তারা আর সহানুভূতি চান না। চান পরিবর্তন। তারা যে ভাষায় কথা বলছেন, সেখানে করুণা নেই, দৃঢ়তা আছে; অনুরোধ নেই, অধিকার আছে।
- প্রবেশগম্যতা নাগরিক অধিকার: তাদের প্রথম দাবি একেবারেই স্পষ্ট—দেশের প্রতিটি ভবন, প্রতিটি যানবাহন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রতিটি ডিজিটাল সেবা ব্যবহারযোগ্য হতে হবে সবার জন্য। শুধু নতুন নির্মাণ নয়, পুরনো কাঠামোকেও সময়সীমা বেঁধে সংস্কার করতে হবে। প্রবেশগম্যতা কোনো সুবিধা নয়, এটি নাগরিক অধিকারের ভিত্তি।
- চাকরি নয়, সুযোগ ও সমতা: তারা চান বৈষম্যমুক্ত নিয়োগ। বিশেষ কোটার ওপর নির্ভর করে নয়, বরং যোগ্যতার ভিত্তিতে মূলধারায় প্রতিযোগিতা করে কাজ করার সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তাও তাদের অধিকার, উপকার নয়।
- অন্তর্ভুক্তিমূলক একীভূত মানসম্পন্ন শিক্ষা: শিশুদের আলাদা স্কুলে ঠেলে দেওয়া বা বয়সভিত্তিক কটূক্তির মধ্যে রেখে বড় করা—এসব যেন অতীত হয়। মূলধারার স্কুলে প্রশিক্ষিত শিক্ষক, সহায়ক প্রযুক্তি এবং শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ—এটাই তাদের প্রত্যাশা।
- জবাবদিহিতা: আইন কাগজে নয়, প্রয়োগেই শক্তিশালী—এই কথাটি বাস্তবে দেখতে চান তারা। প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত না করলে, বৈষম্যমূলক আচরণ করলে, অপরাধকারীর শাস্তি চাই দ্রুত ও কঠোরভাবে। এই দাবিগুলো ব্যক্তিগত সমস্যার নয়, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রশ্ন।
অবিশ্বাসের ইতিহাস: কেন সুযোগ দেখেও ভয় পান তারা
বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ, “ঘর পোড়া গরু সিঁদুর দেখলেও ভয় পায়।” প্রতিবন্ধী মানুষের অভিজ্ঞতা ঠিক এরই মতো। বারবার বৈষম্য, বারবার ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি, বারবার অবহেলা তাদের মনে জন্ম দিয়েছে গভীর সন্দেহ।
- পরিবারের নীরব বর্জন থেকে শুরু: একজন শিশুর মনে যখন প্রথম আঘাত আসে ঘরের ভেতর থেকেই, তখন ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা তৈরি হওয়া কঠিন। সমাজের সহানুভূতিও বেশিরভাগ সময় থাকে করুণার দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই করুণা তাদের মনকে আরও ছোট করে, কারণ এতে সমানাধিকারের জায়গা থাকে না।
- আইনের ব্যর্থ বাস্তবায়ন তাদের ভেঙে দিয়েছে : ২০১৩ সালের আইন, CRPD–র স্বাক্ষর–সবকিছুই বড় অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল র্যাম্প নেই, কর্মক্ষেত্রে সুযোগ নেই, কোটা পূরণ নেই। যা প্রতিশ্রুতির আলো হিসেবে এসেছিল, তা তাদের চোখে বারবার নিভে গেছে।
- টোকেনিজম: নামমাত্র অন্তর্ভুক্তির ভান: একদিনের অনুষ্ঠান, একটি ফটোসেশন, একজন প্রতিবন্ধী কর্মী নিয়োগ… সবই যেন সাজানো ছবি। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাদের মনে জন্ম দেয় আরও গভীর সন্দেহ—“আমাদের কি সত্যিই দেখা হচ্ছে, নাকি শুধু দেখানো হচ্ছে?”
বিশ্বাস পুনর্গঠনের পথ: বাহ্যিকতা নয়, কাঠামোগত পরিবর্তন
বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব, কিন্তু তার পথ সহজ নয়। এটি কেবল স্লোগান বা দিবসের অনুষ্ঠান দিয়ে সম্ভব নয়। প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন।
- প্রথমত, আইনকে জীবন্ত করতে হবে। প্রতিটি ধারা কার্যকর করতে হবে, শুধু ঘোষণা নয়।
- দ্বিতীয়ত, প্রবেশগম্যতা সারাবছরের দায়িত্ব। একটি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী কোনো ঘোষণা ছাড়াই বাসে উঠতে পারলে, তখনই পরিবর্তনের ভাষা স্পষ্ট হবে।
- তৃতীয়ত, সফলতার গল্প সামনে আনতে হবে, যাতে সমাজ বুঝতে পারে প্রতিবন্ধী মানুষ করুণার পাত্র নয়, সমাজের সক্রিয় নির্মাতা।
অবিশ্বাস জন্মেছে বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে। সেটিকে দূর করতে হলে দরকার ধৈর্য, সত্যিকারের আন্তরিকতা এবং জবাবদিহি।
শেষ কথা: কান্না নয়, অধিকারই আগামী পথ
আজকের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বার্তা খুব পরিষ্কার—করুণা নয়, অধিকার। প্রতীকী সেমিনার নয়, বাস্তব প্রবেশগম্যতা। কাগুজে প্রতিশ্রুতি নয়, জবাবদিহি। যেদিন দেশের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি অফিস, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ একজন প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সহজ হবে, সেদিনই ৩ ডিসেম্বর হয়ে উঠবে সত্যিকার অন্তর্ভুক্তির দিন। সেদিন আর নীরব কান্না থাকবে না; শোনা যাবে মর্যাদা, সক্ষমতা এবং সমতার বিজয়ের আওয়াজ।
- ড. মাহবুব লিটু, অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#InternationalDisabilityDay #প্রতিবন্ধীঅধিকার #DisabilityRights #AccessibleBangladesh #প্রবেশগম্যতা #InclusiveEducation #DisabilityInBangladesh #Tokenism #CRPD #BangladeshDisabilityMovement #করুণা_নয়_অধিকার #LeaveNoOneBehind #DrMahbubLitu

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: