অধিকার পত্র ডেস্ক │ প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর ২০২৫
ঢাকা: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযান আন্তর্জাতিক আইনি অঙ্গনে নতুন এক মোড়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ–এর পক্ষ থেকে আইনজীবীরা বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি কেন্দ্র (ICSID)-এ সালিশের আবেদন করেছেন।
তাদের অভিযোগ, সরকারের সম্পদ পুনরুদ্ধার অভিযানে ‘লক্ষ্যভিত্তিক অভিযান’ চালানো হয়েছে, যার ফলে তাদের পারিবারিক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে “শত শত মিলিয়ন ডলার” সমপরিমাণ। বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সুরক্ষা আইনের আওতায় বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি (BIT)-এর পরীক্ষায় পরিণত হচ্ছে।
২০০৪ সালের চুক্তির আইনি কাঠামো
২০০৪ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর বিনিয়োগ চুক্তি অনুযায়ী, উভয় দেশের নাগরিক বিনিয়োগকারী হিসেবে সুরক্ষা পাবেন। চুক্তিটি বিনিয়োগে ন্যায্য ও সমান আচরণ, সম্পূর্ণ সুরক্ষা, পুঁজির অবাধ স্থানান্তর, এবং বিনিয়োগ বাজেয়াপ্ত হলে ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা দেয়।
এছাড়া, বিনিয়োগকারী ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে ছয় মাসের ‘কুলিং-অফ’ সময় শেষে ICSID-এ মামলা করা যায়।
তবে ICSID–এর Article 25(2)(a) অনুসারে, যদি কোনো বিনিয়োগকারীর দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকে এবং তার একটি নাগরিকত্ব বিবাদযুক্ত রাষ্ট্রের (এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ) হয়, তাহলে আদালতের এখতিয়ার (jurisdiction) থাকবে না। অর্থাৎ, যারা একই সময়ে বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন, তারা ICSID–এ মামলা করতে পারবেন না।
নাগরিকত্ব ও বিনিয়োগের সময়রেখাই এখন মূল বিষয়
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এস আলম পরিবারের কয়েকজন সদস্য সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। তবে এটি কোন তারিখে হয়েছে—এই টাইমলাইনই এখন মামলার মূল প্রশ্ন।
যদি দেখা যায় যে তারা বাংলাদেশি নাগরিক থাকা অবস্থায় বিনিয়োগ করেছেন, তবে সেই সম্পদ “সিঙ্গাপুরি বিনিয়োগ” হিসেবে বিবেচিত হবে না এবং BIT সুরক্ষা পাবে না।
বাংলাদেশ এই যুক্তিতে ‘অপব্যবহার প্রতিরোধ (abuse of process)’ ধারায়ও প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে পারে। এর উদাহরণ রয়েছে — Philip Morris Asia বনাম অস্ট্রেলিয়া মামলায় আদালত বিনিয়োগ পুনর্গঠনকে “অযৌক্তিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে মামলা খারিজ করেছিল।
বাংলাদেশের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক ঝুঁকি
এস আলম পরিবার দাবি করছে, সম্পদ জব্দ, তদন্ত এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তাদের বিনিয়োগের অধিকার লঙ্ঘন ও পরোক্ষ বাজেয়াপ্তকরণের (indirect expropriation) সমান।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বলছে, এটি একটি আইনসম্মত দুর্নীতি দমন ও সম্পদ পুনরুদ্ধার অভিযান, যেখানে ন্যায্য প্রক্রিয়া (due process) অনুসরণ করা হচ্ছে।
চুক্তির ভাষা পুরনো হওয়ায় “জনস্বার্থে গৃহীত পদক্ষেপের” বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত নয়, ফলে সঠিক প্রক্রিয়া ও ভারসাম্য (proportionality)—এই দুটি মানদণ্ডই সালিশের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
বাংলাদেশ আগে Saipem বনাম বাংলাদেশ ও Niko Resources মামলায় ICSID-এ জড়িয়েছে। সেসব মামলায় ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে এবং বড় অঙ্কের জরিমানা ধার্য হয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের Tethyan Copper বনাম পাকিস্তান মামলায় ৫.৯ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের নজির দেখিয়েছে—যা এখনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় আর্থিক সতর্কবার্তা হিসেবে ধরা হয়।
করণীয় কী
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মামলা বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি “গভর্নেন্স টেস্ট”, কোনো প্রচারযুদ্ধ নয়।
- সরকারকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সালিশ বিশেষজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে;
- বিনিয়োগের সময়রেখা, মালিকানা ও নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করতে হবে;
- এবং জনগণের আস্থা রক্ষায় সংযত, তথ্যভিত্তিক অবস্থান নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি বাংলাদেশ প্রক্রিয়াগতভাবে স্বচ্ছ থাকে, তবে এই মামলায় জেতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অন্যথায়, এটি হতে পারে একটি ব্যয়বহুল আন্তর্জাতিক ঝুঁকি, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনোভাবেও প্রভাব ফেলতে পারে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: